Positive বার্তা (বাংলা)

A teamwork initiative of Enthusiastic people using Social Media Platforms

Homeব্লগপ্রাচীন ভারতের বিস্ময়—কৈলাস মন্দির: এক পাথরের ভেতর জন্ম নেওয়া অপূর্ব শিল্পকীর্তি

প্রাচীন ভারতের বিস্ময়—কৈলাস মন্দির: এক পাথরের ভেতর জন্ম নেওয়া অপূর্ব শিল্পকীর্তি

The Monolithic Marvel of India: ভারতের প্রাচীন স্থাপত্যশৈলীর এক অনন্য নিদর্শন হলো মহারাষ্ট্রের ঔরঙ্গাবাদ জেলার এলোরা গুহায় অবস্থিত কৈলাস মন্দির। এটি কেবল একটি ধর্মীয় উপাসনালয় নয়, বরং মানব ইতিহাসের অন্যতম বিস্ময়কর শৈল্পিক সৃষ্টি। একক শিলাখণ্ড খোদাই করে তৈরি এই মন্দিরটি শৈলশিল্পের এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে, যার তুলনা বিশ্বে খুব কমই দেখা যায়।

পাথরের বুকে লেখা এক ইতিহাস

৮ম শতাব্দীতে রাষ্টকূট রাজবংশের রাজা কৃষ্ণ প্রথমের নির্দেশে নির্মিত হয় এই মন্দির। পৌরাণিক কৈলাস পর্বতের আদলে নির্মিত এই মন্দিরটি ভগবান শিবের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করা হয়। এটি ‘কৈলাস মন্দির’ নামে পরিচিত হলেও এটি এলোরা গুহার ১৬ নম্বর গুহা হিসেবে তালিকাভুক্ত।

মন্দিরটি একটিমাত্র বিশাল পাথরের পাহাড় কেটে তৈরি করা হয়েছে। অর্থাৎ, এটি একটি মোনোলিথিক স্থাপত্য, যেখানে নির্মাণের জন্য কোনও ইট, পাথর বা বালির ব্লক ব্যবহার করা হয়নি। শুধু খোদাই, কাটা এবং নকশার মাধ্যমে একটানা পাহাড়ের গায়ে নির্মিত হয়েছে এই দৃষ্টিনন্দন মন্দির।

বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রায় ২,০০,০০০ টনেরও বেশি পাথর সরিয়ে তৈরি করা হয়েছিল মন্দিরটি। এই বিশাল কাজটি সম্পন্ন করতে সময় লেগেছিল বহু বছর। তবে অবাক করার বিষয় হলো, প্রাচীন ভারতে যখন আধুনিক যন্ত্রপাতির কোনও অস্তিত্ব ছিল না, সেই সময়ে মানুষ কীভাবে এত নিখুঁত এবং সুবিন্যস্তভাবে একটি পুরো মন্দির পাহাড় কেটে তৈরি করল, সেটাই এখনও এক রহস্য।

স্থাপত্যকলা ও নান্দনিকতা

কৈলাস মন্দির স্থাপত্যের দিক থেকে শুধুই বিশাল নয়, এর মধ্যে লুকিয়ে আছে এক অনবদ্য শৈল্পিক রুচি। মন্দিরে প্রবেশ করলেই চোখে পড়ে খোদাই করা স্তম্ভ, অলংকৃত মণ্ডপ, এবং কেন্দ্রস্থলে শিবলিঙ্গ। নন্দীর মূর্তি সামনে বসানো আছে, যা শিবের বাহন হিসেবে পরিচিত। পুরো মন্দিরজুড়ে রামায়ণ ও মহাভারতের বিভিন্ন দৃশ্য খোদাই করে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে, যা সেই সময়ের শিল্পীদের দক্ষতা এবং কল্পনাশক্তির প্রমাণ বহন করে।

মন্দিরের অলংকরণে ব্যবহৃত হয়েছে সুচারু খোদাই, ভাস্কর্য ও স্থাপত্যের এক নিপুণ সংমিশ্রণ। প্রতিটি স্তম্ভ, প্রতিটি খাঁজ এবং প্রতিটি মূর্তি এমনভাবে তৈরি হয়েছে যেন তারা জীবন্ত হয়ে উঠেছে। এই মন্দিরটি উপর থেকে নিচের দিকে খোদাই করা হয়েছে, অর্থাৎ পাথরের চূড়া থেকে কাজ শুরু করে ধাপে ধাপে নিচের দিকে নেমে এসেছে নির্মাণপ্রক্রিয়া—এটিও এক অসাধারণ কৌশল, যা তখনকার সময়ে বিরল ছিল।

ধর্মীয় সহাবস্থান ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য

কৈলাস মন্দির শুধু হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের জন্য একটি তীর্থস্থান নয়, এটি ভারতের ধর্মীয় সহিষ্ণুতা এবং সাংস্কৃতিক সহাবস্থানের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এলোরা গুহার মোট ৩৪টি গুহার মধ্যে হিন্দু, বৌদ্ধ ও জৈন—এই তিন ধর্মের স্থাপত্য একত্রে অবস্থান করছে। এটি বিশ্বের বুকে ভারতের ধর্মীয় ঐক্যের এক চিরন্তন চিহ্ন।

এমন একটি স্থান যেখানে ধর্মীয় ভেদাভেদের ঊর্ধ্বে উঠে একত্রে সৃষ্টি হয়েছে অপূর্ব স্থাপত্য, যা আজও ইতিহাসপ্রেমী, পর্যটক ও গবেষকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু।

ইউনেস্কো স্বীকৃত বিশ্ব ঐতিহ্য

কৈলাস মন্দিরসহ পুরো এলোরা গুহা ইউনেস্কো ঘোষিত একটি বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান। এই স্বীকৃতি শুধু ভারতের জন্য গর্বের নয়, বরং সমগ্র মানবসভ্যতার জন্য এক মূল্যবান রত্ন। ইউনেস্কো এই স্থানটিকে বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে এর ইতিহাস, স্থাপত্য এবং সাংস্কৃতিক গুরুত্ব বিবেচনা করে।

আজকের প্রেক্ষাপটে কৈলাস মন্দির

বর্তমানে কৈলাস মন্দির কেবলমাত্র একটি ধর্মীয় তীর্থস্থান নয়, এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন কেন্দ্র হিসেবেও পরিগণিত। দেশ-বিদেশের হাজার হাজার পর্যটক প্রতিদিন এই মন্দির পরিদর্শন করতে আসেন। অনেকেই এই মন্দিরকে ভারতের ‘রক-কাট মার্ভেল’ বলে অভিহিত করেন।

তরুণ স্থপতি ও শিল্পীরা এখানে এসে প্রাচীন স্থাপত্যরীতি ও কৌশল থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেন। বহু ইতিহাসবিদ ও গবেষক এখনো এই মন্দিরের নির্মাণ কৌশল বিশ্লেষণ করে চলেছেন, কারণ এই ধরনের কাজ আধুনিক প্রযুক্তির আগেও কিভাবে সম্ভব হয়েছিল, তা এখনো বিস্ময় উদ্রেক করে।

কৈলাস মন্দির শুধু একটি ধর্মীয় উপাসনালয় নয়, এটি ভারতের অতীতের গৌরব, প্রাচীন স্থাপত্যবিদ্যার শ্রেষ্ঠ নিদর্শন এবং মানব সৃষ্টির পরাকাষ্ঠার প্রতীক। এর প্রতিটি স্তম্ভ, খোদাই এবং ভাস্কর্য আমাদের নিয়ে যায় সেই যুগে, যখন মানুষের মেধা ও নিষ্ঠা দিয়ে পাথরের বুকে সৃষ্টি করা হতো স্বপ্নের রাজপ্রাসাদ।

আজও কৈলাস মন্দির তার শতাব্দীপ্রাচীন ঐতিহ্য বহন করে দাঁড়িয়ে আছে ভারতের হৃদয়ে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যেন আরও গৌরবান্বিত হয়ে উঠছে এই অতুলনীয় শিল্পকীর্তি। তাই, যখনই আমরা প্রাচীন ভারতের শৈল্পিক কৃতিত্বের কথা বলি, কৈলাস মন্দির নিঃসন্দেহে সেই তালিকার শীর্ষে স্থান করে নেয়—যেখানে পাথরের মধ্যে লেখা আছে এক চিরন্তন মহাকাব্য।

আরও পড়ুন: সিকিম: ‘নতুন প্রাসাদ’-এর লুকানো ইতিহাস

Join Our WhatsApp Group For New Update
RELATED ARTICLES

1 COMMENT

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_img

সবচেয়ে জনপ্রিয়