- নদিয়া জেলার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শহর রানাঘাট, শুধু একটি ভৌগোলিক অবস্থান নয়; এটি ইতিহাস, লোককথা আর সংস্কৃতির এক দারুণ মিশেল। এই শহরের নামকরণের পেছনে রয়েছে নানা গল্প, যা রানাঘাটকে আরও আকর্ষণীয় করে তোলে।
রানির ঘোড়ার পায়ের ছাপ: লোককাহিনির রানাঘাট
জনপ্রিয় লোককথা অনুসারে, এক সময় এক প্রতাপশালী রানি প্রতিদিন শিকার করতে এই অঞ্চলে আসতেন। চূর্ণি নদীর ধারে একটি নির্জন জায়গায় তাঁর ঘোড়া বিশ্রাম নিত। সেখানেই রানির ব্যবহারের জন্য একটি ‘ঘাট’ তৈরি হয়। সেই থেকেই এই স্থানের নাম হয় “রানির ঘাট”, যা কালের বিবর্তনে সংক্ষেপিত হয়ে “রানাঘাট” হয়েছে। এই গল্পটি স্থানীয় প্রবীণদের মুখে মুখে ফেরে এবং শহরের ঐতিহ্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে।
ইতিহাসের রেলগাড়ি: ব্রিটিশ যুগে ‘রুনাঘাটা’
ব্রিটিশ শাসনামলে যখন পূর্ব রেলওয়ের বিস্তার ঘটে, তখন রানাঘাট একটি গুরুত্বপূর্ণ রেল জংশন হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। পুরনো নথিপত্রে এই স্থানের নাম “Roonaghata” হিসেবে উল্লেখ পাওয়া যায়, যা স্থানীয় উচ্চারণের প্রভাবে ধীরে ধীরে “Ranaghat”-এ রূপান্তরিত হয়। নদীপথ এবং রেলপথের এই সংযোগ রানাঘাটকে সেই সময়ের একটি প্রধান প্রশাসনিক ও যোগাযোগ কেন্দ্রে পরিণত করেছিল।
সংস্কৃতির সুরে ‘রানাঘাট’
রানাঘাটের গুরুত্ব শুধু ইতিহাস বা লোককথায় সীমাবদ্ধ নয়, এটি বাংলার সংস্কৃতিতেও নিজের স্থান করে নিয়েছে। এই শহর থেকে উঠে এসেছেন গুণী শিল্পী অরুণ দত্ত এবং সাম্প্রতিক সময়ে ভাইরাল হওয়া শিল্পী রানু মণ্ডল, যাঁদের কণ্ঠের মাধ্যমে রানাঘাটের নাম দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছে। নাটক, গান, সাহিত্য— বিভিন্ন ক্ষেত্রেই রানাঘাট বাঙালির আবেগ ও সৃজনশীলতার সঙ্গে মিশে গেছে।
নদী, নাম আর নস্টালজিয়া
চূর্ণি নদীর তীরে অবস্থিত রানাঘাট শুধু একটি শহর নয়— এটি এক সময়ের গুরুত্বপূর্ণ নদীঘাট, এক রেলপথের কেন্দ্র এবং বর্তমানের অগ্রগতির প্রতীক। এই নামের প্রতিটি অক্ষর ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং মানুষের অনুভূতির এক দারুণ মেলবন্ধন।
উপসংহার: নামের পেছনে হারিয়ে যাওয়া এক শহর
‘রানাঘাট’ নামটি রানির পদচিহ্ন, ট্রেনের হুইসেল আর নদীর কলতানকে ধারণ করে। এই নামটি যেন ইতিহাসের পাতায় লেখা এক জীবন্ত গল্প, যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে আমাদের শেকড়ের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। রানাঘাট কেবল একটি স্থাননাম নয়, এটি পরিচয়, বিশ্বাস এবং অনুভূতির এক অপূর্ব প্রতীক, যা আজও তার গৌরব বহন করে চলেছে।
[…] […]