A New Scientific Discovery: শরীর সুস্থ রাখতে এবং ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে শর্করা জাতীয় খাবার কম খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু অনেকেই আছেন, যারা মিষ্টি বা কার্বোহাইড্রেট-সমৃদ্ধ খাবার এড়িয়ে চলতে চাইলেও, শেষ পর্যন্ত লোভ সামলাতে পারেন না। কেউ কেউ হয়তো খেতে না চাইলেও দিনভর লুচি, পরোটা, কচুরি বা নুডলস খাওয়ার প্রতি আকৃষ্ট থাকেন। অথচ এমন আচরণের পেছনে থাকতে পারে এক জটিল মানসিক কারণ।
সম্প্রতি জার্মানির বন বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা গেছে, শর্করা জাতীয় খাবারের প্রতি আকর্ষণ আসলে মানসিক অবসাদের একটি উপসর্গ হতে পারে। অনেকেই মনে করেন, অবসাদগ্রস্ত ব্যক্তিরা সাধারণত খাওয়ার প্রতি অনাগ্রহী হন। কিন্তু গবেষণাটি বলছে ভিন্ন কথা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মানসিক অবসাদ কখনো কখনো খাবারের প্রতি আকর্ষণ বাড়িয়েও দিতে পারে, বিশেষ করে শর্করা এবং স্নেহপদার্থ-সমৃদ্ধ খাবারের প্রতি।
গবেষণার ফলাফল কী বলছে?
বন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক নিলস ক্রিমার ও তাঁর সহকর্মীরা ১১৭ জনের ওপর একটি পরীক্ষা চালান। অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ৫৪ জন মানসিক অবসাদে ভুগছিলেন, আর ৬৩ জন ছিলেন সম্পূর্ণ সুস্থ। গবেষণার উদ্দেশ্য ছিল তাঁদের খাদ্যাভ্যাস বিশ্লেষণ করা এবং মানসিক অবস্থার সঙ্গে খাবারের সম্পর্ক বোঝা।
অংশগ্রহণকারীদের দুটি প্রশ্ন করা হয়েছিল—কোন খাবারটি তাঁরা খেতে চান এবং কোন খাবারটি তাঁদের বেশি ভালো লাগে। দেখা যায়, অবসাদগ্রস্ত ব্যক্তিদের মধ্যে খাবারের প্রতি আগ্রহ কম থাকলেও, তাঁদের খাদ্যপছন্দ মূলত উচ্চ শর্করা ও স্নেহপদার্থযুক্ত খাবারের দিকেই ঝুঁকে ছিল। প্রোটিন বা ফ্যাটসমৃদ্ধ খাবারের প্রতি তাঁদের আকর্ষণ ছিল তুলনামূলকভাবে কম।
গবেষণায় উঠে এসেছে, অবসাদগ্রস্তদের বেশিরভাগই এমন খাবার পছন্দ করেছেন, যাতে প্রচুর শর্করা রয়েছে। বিশেষ করে মিল্ক চকলেটের প্রতি তাঁদের ঝোঁক ছিল বেশি। এ থেকে স্পষ্ট হয় যে, শর্করার প্রতি আকর্ষণ মানসিক অবস্থার উপর নির্ভর করতে পারে এবং এটি উদ্বেগ ও বিষণ্ণতার সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কযুক্ত।
কেন শর্করার প্রতি আকৃষ্ট হন অবসাদগ্রস্তরা?
মানসিক অবসাদ বা উদ্বেগের সময় মস্তিষ্কের নিউরোট্রান্সমিটারগুলোর ভারসাম্য বিঘ্নিত হয়। বিশেষ করে ‘সেরোটোনিন’ নামক হরমোনের মাত্রা কমে যায়, যা মুড বা মনোভাব নিয়ন্ত্রণ করে। শর্করা জাতীয় খাবার খেলে শরীরে ইনসুলিন নিঃসরণ বাড়ে, যা সেরোটোনিন উৎপাদনে সহায়ক। ফলে সাময়িকভাবে মনের অবস্থা কিছুটা ভালো লাগে।
এ কারণেই অনেকে স্ট্রেস বা দুশ্চিন্তার সময় বেশি মিষ্টি বা কার্বোহাইড্রেট সমৃদ্ধ খাবার খেতে চান। এটি এক ধরনের স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া, যেখানে মস্তিষ্ক স্বাচ্ছন্দ্য খোঁজে। তবে দীর্ঘমেয়াদে এটি শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে, কারণ অতিরিক্ত শর্করা গ্রহণ ওজন বৃদ্ধি, ডায়াবেটিস, এবং আরও নানা ধরনের সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে।
উদ্বেগ ও শর্করার যোগসূত্র
গবেষক লিলি থর্ন জানিয়েছেন, শর্করা খাওয়ার প্রবণতা শুধু খাদ্যাভ্যাসের অংশ নয়, এটি মানসিক অবস্থার প্রতিফলনও হতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে, উদ্বেগে থাকা ব্যক্তিদের মধ্যে এই প্রবণতা আরও বেশি। উদ্বেগ বাড়লে অনেকেই খাবারের মাধ্যমে স্বস্তি খোঁজেন এবং বিশেষ করে শর্করা সমৃদ্ধ খাবারের প্রতি তাঁদের আকর্ষণ বাড়ে।
লিলি থর্ন বলেন, ‘‘শর্করা খাওয়ার প্রবণতা শুধু শারীরিক ক্ষুধার ওপর নির্ভর করে না, বরং এটি অনেকাংশে মানসিক অবস্থার সঙ্গেও যুক্ত। অবসাদ ও উদ্বেগগ্রস্ত ব্যক্তিরা হয়তো অনিচ্ছাকৃতভাবেই বেশি শর্করা গ্রহণ করেন, যা তাঁদের মস্তিষ্কের অস্বস্তি দূর করতে সাময়িক স্বস্তি দেয়।’’
মানসিক স্বাস্থ্য ও খাদ্যাভ্যাস
এই গবেষণার ফলাফল ভবিষ্যতে মানসিক স্বাস্থ্য চিকিৎসার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। এখন পর্যন্ত মানসিক অবসাদের চিকিৎসায় মূলত ওষুধ ও থেরাপির ওপর জোর দেওয়া হয়। কিন্তু খাদ্যাভ্যাসও যে মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে, তা নিয়ে তুলনামূলকভাবে কম আলোচনা হয়।
গবেষকদের মতে, মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখতে সুষম খাদ্যাভ্যাস অত্যন্ত জরুরি। শুধুমাত্র শর্করা জাতীয় খাবার নির্ভরতা কমিয়ে যদি প্রোটিন, ফাইবার, স্বাস্থ্যকর ফ্যাট ও ভিটামিনযুক্ত খাবার বেশি গ্রহণ করা যায়, তবে তা মানসিক অবস্থার উন্নতি ঘটাতে পারে।
কীভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়?
যদি মানসিক অবসাদ বা উদ্বেগের কারণে অতিরিক্ত শর্করা গ্রহণের প্রবণতা দেখা দেয়, তাহলে তা নিয়ন্ত্রণের জন্য কিছু উপায় অবলম্বন করা যেতে পারে—
১. প্রতিদিন পর্যাপ্ত পরিমাণে প্রোটিন ও ফাইবার গ্রহণ করুন
– প্রোটিন ও ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার বেশি খেলে ক্ষুধা কম অনুভূত হয় এবং দীর্ঘক্ষণ পেট ভরা লাগে। এতে শর্করা খাওয়ার ইচ্ছাও কমে আসে।
- পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করুন
– অনেক সময় শরীরে পানির অভাব হলেও ক্ষুধা লাগে এবং মিষ্টি খাওয়ার ইচ্ছে বাড়তে পারে। তাই দিনে অন্তত ৮-১০ গ্লাস পানি পান করা উচিত। - শারীরিক কার্যকলাপ বৃদ্ধি করুন
– ব্যায়াম করলে শরীরে এন্ডোরফিন নামক হরমোন নিঃসরণ হয়, যা প্রাকৃতিকভাবে মানসিক অবসাদ ও উদ্বেগ কমাতে সাহায্য করে। - অপরিষ্কার বা প্রসেসড খাবার এড়িয়ে চলুন
– অতিরিক্ত শর্করা ও স্নেহপদার্থযুক্ত জাঙ্ক ফুডের পরিবর্তে পুষ্টিকর খাবার বেছে নেওয়া উচিত। - নিয়মিত মেডিটেশন ও মানসিক চর্চা করুন
– ধ্যান, যোগব্যায়াম ও মানসিক প্রশান্তি বৃদ্ধির বিভিন্ন পদ্ধতি মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখতে সাহায্য করতে পারে।
শর্করা জাতীয় খাবারের প্রতি আকৃষ্ট হওয়া শুধুমাত্র খাদ্যাভ্যাসের অংশ নয়, এটি মানসিক অবসাদ ও উদ্বেগের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত হতে পারে। গবেষণায় উঠে আসা এই নতুন তথ্য ভবিষ্যতে মানসিক স্বাস্থ্য গবেষণায় নতুন দিগন্ত খুলে দিতে পারে। তাই শুধু শরীর নয়, মনের সুস্থতার দিকেও নজর দেওয়া জরুরি, যাতে খাদ্যাভ্যাস নিয়ন্ত্রণ করে সুস্থ জীবন যাপন করা সম্ভব হয়।
আরো পড়ুন: ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা বাড়লে কী করবেন? জেনে নিন কার্যকরী ভেষজ পানীয়
[…] […]
[…] […]