Radhanath Sikdar: আজ আন্তর্জাতিক মাউন্ট এভারেস্ট দিবস। এই দিনে আমরা সাধারণত স্মরণ করি স্যার এডমন্ড হিলারি ও তেনজিং নোরগের দুর্ধর্ষ অভিযানকে, যাঁরা ১৯৫৩ সালে প্রথম এভারেস্টের চূড়ায় পা রাখেন। কিন্তু ইতিহাসের পাতায় আরেকটি নাম রয়েছে — যা আজও অনেকের অজানা। তিনি রাধানাথ সিকদার — একজন বাঙালি গণিতবিদ, যিনি কখনও পর্বতারোহণ করেননি, কিন্তু তাঁর গণিতজ্ঞ মস্তিষ্ক দিয়ে স্পর্শ করেছিলেন পৃথিবীর সর্বোচ্চ বিন্দু।
📜 ঐতিহাসিক পটভূমি: যখন শিখর ছিল এক রহস্য
১৮০০ সালের প্রথমভাগে, ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতবর্ষ জয় করলেও উপমহাদেশের ভূগোল তখনও তাদের কাছে এক রহস্য। এই রহস্য উন্মোচনের লক্ষ্যে শুরু হয় The Great Trigonometrical Survey — এক বিশাল ভূ-পরিমাপক প্রকল্প, যার মাধ্যমে তারা ভারতবর্ষের মানচিত্র বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে তৈরি করতে চেয়েছিল।
এই প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তৎকালীন যুগের খ্যাতনামা ব্রিটিশ ও ভারতীয় বিজ্ঞানীরা। কিন্তু এক তরুণ বাঙালি গণিতবিদের আবির্ভাব সেই গোটা প্রক্রিয়াকেই এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে যায়।
👨🔬 রাধানাথ সিকদার (Radhanath Sikdar): এক প্রতিভার উত্থান
রাধানাথ সিকদার জন্মগ্রহণ করেন ১৮১৩ সালে, কলকাতায়। শৈশবেই তাঁর প্রতিভার ছাপ পড়ে গণিত ও জ্যামিতিতে। পরবর্তীকালে হিন্দু কলেজে পড়াকালীন সময়েই তিনি ব্রিটিশ গণিতজ্ঞ জন টেটলার এবং হেনরি হেনেসির মতো শিক্ষকদের সান্নিধ্যে আসেন। ১৮৩১ সালে মাত্র ১৯ বছর বয়সে তিনি ব্রিটিশ সরকারের Survey of India-তে যোগ দেন এবং শিগগিরই হয়ে ওঠেন এই প্রকল্পের এক গুরুত্বপূর্ণ সদস্য।
🔍 Peak XV: এক শৃঙ্গ, অজানা উচ্চতা
হিমালয়ের বুকে একটি রহস্যময় তুষারাবৃত শৃঙ্গ — যার নাম তখন “Peak XV”, এবং যে সম্পর্কে কারোরই সুনির্দিষ্ট ধারণা ছিল না। অধিকাংশ বিশেষজ্ঞ তখনও মনে করতেন কাঞ্চনজঙ্ঘা-ই বিশ্বের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ। কিন্তু হাওয়ায় উড়ছিল গুজব, শেরপাদের গল্প, জরিপকারীদের বর্ণনায় উঠে আসছিল এই পিক XV-এর কথা — যা কিনা দূর থেকে অস্বাভাবিক উঁচু মনে হতো।
এই রহস্য উদঘাটনের দায়িত্ব পড়ে রাধানাথ সিকদারের ওপর। এবং এখানে ঘটে যায় ইতিহাস।
📐 গণিতের জাদু: এভারেস্টের উচ্চতা নির্ণয়
রাধানাথ ব্যবহার করেন গোলীয় ত্রিকোণমিতি, এবং সেই সময়ের অন্যতম জটিল গাণিতিক কৌশল — বায়ুমণ্ডলীয় প্রতিসরণ ও ত্রিভুজকরণ পদ্ধতি (Triangulation)। এই সমস্ত বিশ্লেষণের ভিত্তিতে, তিনি গণনা করে দেখান যে Peak XV-এর উচ্চতা ২৯,০০২ ফুট — যা সমকালীন সমস্ত শৃঙ্গের তুলনায় বেশি।
এই নিরূপণ ছিল এক যুগান্তকারী মুহূর্ত — কারণ কেউই তখনও এই শৃঙ্গের নিকটবর্তী হয়নি, এমনকি এর স্থানীয় নামও ব্রিটিশদের অজানা ছিল।
🏔️ ‘মাউন্ট এভারেস্ট’ নামকরণ (Radhanath Sikdar): এক বিতর্কিত শ্রদ্ধা
এই উচ্চতা নির্ধারণের পর তৎকালীন সার্ভেয়ার জেনারেল অ্যান্ড্রু ওয়াঘ (Andrew Waugh), পিক XV-এর নামকরণ করেন ‘মাউন্ট এভারেস্ট’ — তাঁর পূর্বসূরি স্যার জর্জ এভারেস্ট-এর সম্মানে। যদিও জর্জ এভারেস্ট নিজে এই নামকরণের বিরোধিতা করেছিলেন, কারণ এটি স্থানীয় সংস্কৃতিকে উপেক্ষা করেছিল। অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন, সিকদারের নামেই এই শৃঙ্গের নাম হওয়া উচিত ছিল।
এটাই এক চিরন্তন বিতর্ক: যিনি পর্বতের উচ্চতা নির্ধারণ করলেন, তাঁর নাম আজও বিস্মৃতপ্রায়; আর যিনি কখনও হিমালয়ে যাননি, তাঁর নামে বিশ্বের সর্বোচ্চ পর্বতের নাম!
🧠 বিজ্ঞান ও দূরদৃষ্টির জয়
রাধানাথ সিকদার শুধুই একজন গণিতবিদ ছিলেন না, তিনি ছিলেন বিজ্ঞানমনস্কতা ও দূরদর্শিতার প্রতীক। তাঁর কাজ দেখিয়ে দেয় — শুধু যুক্তি, অধ্যবসায় এবং বিশ্লেষণী ক্ষমতা দিয়েই কীভাবে সবচেয়ে কঠিন কাজও সম্পন্ন করা যায়। পাহাড়ে না গিয়েও যে কেউ শিখরে পৌঁছাতে পারেন, রাধানাথ তা প্রমাণ করেছেন।
🕯️ ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এক অনুপ্রেরণা
আজকের দিনে দাঁড়িয়ে যখন আমরা প্রযুক্তি, উপগ্রহ চিত্র, ড্রোন ও জিপিএস ব্যবহার করে পর্বতের উচ্চতা পরিমাপ করি, তখন সিকদারের সময়কার প্রক্রিয়া ছিল অগণিত হিসেব, স্লেট-পেন্সিল আর কঠোর মানসিক শ্রমের ফল।
এই প্রেক্ষিতে তাঁর অবদান শুধু ঐতিহাসিক নয়, এটি এক মহাকাব্যিক অর্জন — যা আমাদের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে প্রেরণা দেয়।
🙏 শ্রদ্ধাঞ্জলি (Radhanath Sikdar): গণিতের মহাশিখরে এক বাঙালি
আন্তর্জাতিক মাউন্ট এভারেস্ট দিবসে, আমরা যখন এভারেস্ট জয়ের সাহসিকতাকে স্মরণ করি, তখন সমানভাবে স্মরণ করা উচিত সেই বাঙালি প্রতিভাকে, যিনি না গিয়েই জয় করেছিলেন পৃথিবীর উচ্চতম শৃঙ্গ। রাধানাথ সিকদারের নাম আজও বহু মানুষ জানেন না, পাঠ্যবইয়ে তাঁর কথা নেই, ইতিহাসেও তাঁর জায়গা সংকুচিত।
তবে এখন সময় এসেছে, তাঁকে তাঁর প্রাপ্য সম্মান দেওয়ার। কারণ, তিনিই ছিলেন সেই প্রথম মানুষ — যিনি মাউন্ট এভারেস্টকে মানব ইতিহাসের মানচিত্রে স্থাপন করেছিলেন।
🕊️ শেষ কথা:
রাধানাথ সিকদার শুধু একটি পর্বতের উচ্চতা মাপেননি, তিনি প্রমাণ করেছেন যে, সীমাবদ্ধতাই মানুষকে শক্তি দেয় — আর গণিত হতে পারে সবচেয়ে শুদ্ধ ভাষা, যেটি পাহাড়ের চূড়াতেও পৌঁছে যেতে পারে। এই মহান বাঙালি বিজ্ঞানী আমাদের গর্ব — এবং তাঁর কীর্তি যুগে যুগে বাঙালির সাহসিকতার প্রতিচ্ছবি হয়ে থাকবে।
আরও পড়ুন: মিজোরাম: ভারতের প্রথম সম্পূর্ণ সাক্ষর রাজ্য – এক যুগান্তকারী সাফল্যের গল্প
[…] […]