CPR: হার্ট অ্যাটাক শব্দটি শুনলেই অনেকের বুক ধক করে ওঠে। পরিবারের কেউ হঠাৎ বুকে হাত চেপে ধরে পড়ে গেলে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে চারপাশে। তবে ভয় নয়, সচেতনতা এবং সঠিক সময়ে নেওয়া পদক্ষেপই হতে পারে জীবনের রক্ষাকবচ।
বিশ্বজুড়ে প্রতিবছর লক্ষ লক্ষ মানুষ হৃদ্রোগে আক্রান্ত হন। সঠিক সময়ে চিকিৎসা না পেলে হার্ট অ্যাটাকের ফলে মৃত্যু অনিবার্য হয়ে ওঠে। কিন্তু আপনি জানলে অবাক হবেন, হাসপাতালে পৌঁছনোর আগেই যদি প্রাথমিক চিকিৎসা বা ‘সিপিআর’ (Cardio Pulmonary Resuscitation) দেওয়া যায়, তাহলে রোগীর প্রাণ বাঁচানো সম্ভব। তাই শুধু চিকিৎসকেরা নয়, সাধারণ মানুষেরও জানা উচিত এই প্রক্রিয়া — কারণ জীবনের লড়াইয়ে আপনি-ই হতে পারেন কারও আশা।
❗হার্ট অ্যাটাক মানেই মৃত্যু নয়
বিশ্বের অন্যতম স্বাস্থ্য গবেষণা সংস্থা CDC (Centers for Disease Control and Prevention) জানাচ্ছে, যারা হাসপাতালে পৌঁছনোর আগেই কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট বা হৃদ্যন্ত্র বন্ধের শিকার হন, তাদের ৯০ শতাংশই বাঁচেন না। তবে তা বলেই হার মানা নয়। গবেষণা বলছে, সঠিক সময়ে CPR দিলে মৃত্যুহার উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায়। তাই CPR শেখা আর বিলাসিতা নয়, বরং একান্ত প্রয়োজনীয় নাগরিক দায়িত্ব।
🫀 হার্ট অ্যাটাকের প্রাথমিক উপসর্গ চেনা খুব জরুরি
বিশেষজ্ঞ ডা. দিলীপ কুমার, যিনি একজন অভিজ্ঞ হৃদ্রোগ চিকিৎসক, তিনি জানিয়েছেন — হার্ট অ্যাটাকের ক্ষেত্রে সময়ই সবচেয়ে বড় ফ্যাক্টর। দ্রুত উপসর্গ চেনা, ওষুধ দেওয়া ও CPR শুরু করাই পারে জীবন রক্ষা করতে।
চেনার মতো কয়েকটি উপসর্গ:
- বুকের মাঝখানে তীব্র ব্যথা, চাপ বা অস্বস্তি
- ঘন ঘন শ্বাসকষ্ট
- ঘাম ঝরছে অস্বাভাবিকভাবে
- ব্যথা হাত, কাঁধ বা চোয়ালে ছড়িয়ে পড়ছে
- হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে যাওয়া
এমন লক্ষণ দেখা দিলে দেরি না করে রোগীকে অ্যাসপিরিন বা সরবিট্রেট জাতীয় ওষুধ দিয়ে দিন এবং অবস্থা খারাপ হলে CPR শুরু করুন।
🛠️ CPR কীভাবে দেবেন? ধাপে ধাপে সহজ ব্যাখ্যা:
১. রোগীকে শোয়ান সমতল জায়গায়
রোগীকে প্রথমেই চিত করে সমান ও শক্ত পৃষ্ঠে শুইয়ে দিন — যেমন মেঝে।
২. ক্যারোটিড পাল্স পরীক্ষা করুন
গলার মাঝখানে যে হাড়টি বেরিয়ে থাকে (অ্যাডামস অ্যাপেল), সেখান থেকে নিচের দিকে আঙুল নামিয়ে স্পন্দন খুঁজুন। কোনও স্পন্দন না পেলে CPR শুরু করুন।
৩. চেস্ট কমপ্রেশন দিন (বুক চেপে CPR)
রোগীর বুকে — ঠিক মাঝখানে (বুকের হাড়ের উপর) চাপ দিতে হবে।
৪. হাতের অবস্থান
ডান হাতে চাপ দিতে হলে, ডান হাতের তালুর নিচের অংশটি রাখুন বুকে, তার উপরে বাঁ হাত রাখুন। কনুই ভাঁজ না করে সোজা হাত রাখুন।
৫. চাপের মাত্রা
বুকের খাঁচা ৫-৬ সেন্টিমিটার নিচু হবে এমনভাবে চাপ দিন। এরপর হাত ছেড়ে বুককে আবার আগের অবস্থায় ফিরতে দিন। এইভাবে বারংবার চাপ দিন।
৬. গতি বজায় রাখুন
এক মিনিটে ১০০-১২০ বার এই চাপ দিতে হবে। টানা ২-৫ মিনিট এমনভাবে CPR চালিয়ে যেতে হবে।
৭. প্রয়োজনে CPR চালিয়ে যান ২০ মিনিট পর্যন্ত
যদি হৃদ্স্পন্দন না ফেরে, CPR ২০ মিনিট পর্যন্ত চালিয়ে যেতে পারেন।
৮. শিশুদের CPR আলাদা
৮ বছরের নিচে বাচ্চাদের ক্ষেত্রে চাপ কম দিতে হবে। প্রথমে ৩০ বার বুক চাপ দিন, না ফিরলে এক হাত দিয়ে নাক বন্ধ করে, অন্য হাত দিয়ে চিবুক তুলুন এবং মুখে মুখ লাগিয়ে দুইবার জোরে হাওয়া দিন। এতে ফুসফুসে অক্সিজেন প্রবেশ করবে।
⚕️ CPR প্রশিক্ষণ থাকলে সেরা, না থাকলেও জানলে কার্যকর
আজকাল অনেক স্কুল, কলেজ এবং কর্পোরেট সংস্থা CPR শেখানোর উদ্যোগ নিচ্ছে। তবে এখনও বহু মানুষ জানেন না CPR-এর গুরুত্ব। তাই অন্তত সঠিক নিয়মটি জানলে, প্রয়োজনের মুহূর্তে আপনি কাউকে সাহায্য করতে পারবেন।
🧠 একটি সত্য গল্প…
কলকাতার উপকণ্ঠে সম্প্রতি ৪৮ বছর বয়সী এক ব্যক্তি হঠাৎ রাত ২টোর সময় বুকের ব্যথা নিয়ে পড়ে যান। বাড়িরই এক আত্মীয় দ্রুত বুদ্ধি করে CPR শুরু করেন — যদিও তিনি চিকিৎসক নন, কিন্তু ইউটিউব দেখে CPR শিখেছিলেন আগেই। অ্যাম্বুল্যান্স আসতে প্রায় ১২ মিনিট সময় লেগেছিল। কিন্তু CPR চালিয়ে যাওয়ার ফলেই হাসপাতাল পর্যন্ত পৌঁছানোর আগেই সেই ব্যক্তি হুঁশ ফিরে পান। বর্তমানে তিনি সুস্থ।
এটাই বাস্তবের উদাহরণ — CPR জানলে আপনি নিজেই কারও জীবন বাঁচাতে পারেন।
🌍 সামগ্রিক সচেতনতা গড়ার সময় এসেছে
হার্ট অ্যাটাক শুধুই বয়স্কদের সমস্যা নয় — আজকাল ৩৫-৪৫ বছর বয়সেও দেখা দিচ্ছে এই সমস্যা। অতিরিক্ত স্ট্রেস, অনিয়মিত জীবনযাপন, জাঙ্ক ফুড, ধূমপান ইত্যাদি হার্টের ক্ষতি করছে নীরবে। তাই CPR জানা প্রতিটি পরিবারের একান্ত প্রয়োজন।
সরকারি এবং বেসরকারি স্তরে CPR শেখানোর ক্যাম্প চালু হলে, প্রতি বাড়িতে তৈরি হবে অন্তত একজন ‘লাইফ সেভার’।
🔚 উপসংহার
সিপিআর হলো এমন একটি সহজ কিন্তু জীবনদায়ী পদ্ধতি, যা সাধারণ মানুষের হাতেও এক অসামান্য ক্ষমতা তুলে দেয় — জীবন বাঁচানোর ক্ষমতা।
আরও পড়ুন: সিকিম: ‘নতুন প্রাসাদ’-এর লুকানো ইতিহাস