When Bengal: বাংলার আকাশ মানেই আবেগ—কখনও কালো মেঘে ঢাকা বর্ষণমুখর বিকেল, কখনও আবার রোদের ফাঁকে হঠাৎ বৃষ্টির গন্ধ। কিন্তু এই আবেগময় আকাশকে বিজ্ঞানের নিরিখে বোঝার সাহস দেখিয়েছিল একদল বাঙালি গবেষক। তাঁদের কাছে মেঘ শুধু কবিতার উপাদান ছিল না, ছিল পরীক্ষাগারের প্রশ্ন; বৃষ্টি শুধু প্রকৃতির দান নয়, ছিল সংখ্যায় ধরা পড়া এক জটিল প্রক্রিয়া। সেই কৌতূহল থেকেই বাংলায় শুরু হয় কসমিক রে, মেঘগঠন ও বৃষ্টিবিজ্ঞানের এক অনন্য যাত্রা।
মহাকাশ থেকে পৃথিবীর দিকে অবিরাম ছুটে আসছে অতি উচ্চশক্তির কণা—যাদের আমরা চিনি কসমিক রে নামে। অধিকাংশই প্রোটন বা হালকা নিউক্লিয়াস, প্রায় আলোর গতিতে এসে তারা পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করে। সেখানে পৌঁছেই শুরু হয় সংঘর্ষের খেলা। বাতাসের অণুর সঙ্গে ধাক্কা লেগে তৈরি হয় আয়ন, ইলেকট্রন আর নানা ক্ষুদ্র কণার শাওয়ার। এই অদৃশ্য ঘটনাগুলিই পরবর্তী ধাপে মেঘ ও বৃষ্টির জন্মের পরিবেশ তৈরি করে।
এই আয়নগুলোর চারপাশে জলীয়বাষ্প জমে তৈরি হয় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ফোঁটা—যাদের বলা যায় মেঘবিন্দুর বীজ। অসংখ্য এমন বীজ একে অপরের সঙ্গে মিশে বড় হতে থাকে। একসময় তাদের ওজন এতটাই বেড়ে যায় যে ভাসমান থাকা সম্ভব হয় না—তখনই তারা বৃষ্টি হয়ে নেমে আসে। অর্থাৎ কসমিক রে সরাসরি বৃষ্টি নামায় না, কিন্তু মেঘবিন্দু তৈরির প্রাথমিক ধাপে তারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে—এই ধারণাটিই ছিল বাঙালি গবেষণার অন্যতম বড় অবদান।
কিন্তু প্রশ্ন ছিল, এই অদৃশ্য কণাগুলিকে দেখা যাবে কীভাবে? উত্তরে আসে ক্লাউড চেম্বার। এক ধরনের স্বচ্ছ পাত্র, যেখানে অতিপরিপৃক্ত বাষ্প রাখা হয়। কোনো চার্জিত কণা এর ভেতর দিয়ে গেলে, তার পথে বাষ্প ঘনীভূত হয়ে ক্ষুদ্র ফোঁটার রেখা তৈরি করে। মুহূর্তের জন্য যেন অদৃশ্য কণার চলাচল চোখের সামনে ধরা পড়ে। বাঙালি গবেষকদের কাছে এই যন্ত্র ছিল এক টুকরো কৃত্রিম আকাশ—যেখানে প্রকৃতির গোপন চালচিত্র দৃশ্যমান হয়।
এই গবেষণাকে আরও গভীরে নিয়ে যেতে হলে শুধুমাত্র জমিনে দাঁড়িয়ে থাকা যথেষ্ট ছিল না। কসমিক রে-এর প্রবাহ যত ওপরে, তত বেশি। তাই পাঁচের দশকে শুরু হয় দুঃসাহসী উদ্যোগ—হাইড্রোজেন ভরা বিশাল বেলুনে করে বৈজ্ঞানিক যন্ত্র পাঠানো উচ্চ বায়ুমণ্ডলে। তখন আধুনিক রকেট প্রযুক্তি সহজলভ্য নয়। যন্ত্রের ওজন, তাপমাত্রা, চাপ, ঝাঁকুনি—সবকিছুর সঙ্গে লড়াই করে তৈরি হয় বেলুন-পরীক্ষা। ১৫ থেকে ২০ কিলোমিটার উচ্চতায় উঠে সেই যন্ত্র ধরা দিত কণার রেখা, যা আসলে ছিল মেঘের জন্মভূমির এক ধরনের ডায়েরি।
এই ধারার গবেষণায় আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পান বাঙালি পদার্থবিদরা। বিশেষ করে দেবেন্দ্র মোহন বসু-এর মতো বিজ্ঞানীরা কসমিক রে শনাক্তকরণের সূক্ষ্ম পদ্ধতি উদ্ভাবন করে দেখিয়েছিলেন, কীভাবে এই কণা বায়ুমণ্ডলের বিদ্যুৎ পরিবাহিতা ও আয়নস্তরের আচরণ বদলে দেয়। তাঁদের কাজ শুধু কণাতত্ত্বেই সীমাবদ্ধ ছিল না; তা খুলে দিয়েছিল আবহাওয়া ও মেঘবিজ্ঞানের নতুন দিগন্ত।
এই তাত্ত্বিক ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়েই বিশ্বজুড়ে পরবর্তী সময়ে আলোচনা শুরু হয় কৃত্রিম বৃষ্টিপাত বা ক্লাউড সিডিং নিয়ে। মেঘের ভেতরে সিলভার আয়োডাইডের মতো কণিকা ছড়িয়ে জলবিন্দুকে বড় করার চেষ্টা—এ ধারণা অনেকটাই নির্ভর করে মেঘবিন্দু গঠনের মৌলিক পদার্থবিদ্যার ওপর। ভারতেও বিভিন্ন রাজ্যে পরীক্ষামূলকভাবে এই প্রযুক্তি ব্যবহার হয়েছে, যেখানে মেঘের গঠন, আর্দ্রতা ও তাপমাত্রা বিচার করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে সিডিং কার্যকর হবে কি না।
এখানেই কসমিক রে গবেষণা ও বৃষ্টিনিয়ন্ত্রণের মধ্যে সূক্ষ্ম যোগসূত্র তৈরি হয়। মহাজাগতিক কণা যে ভাবে বায়ুমণ্ডলে আয়ন তৈরি করে মেঘবিন্দুর বীজ গঠনে সাহায্য করে—সেই একই যুক্তি মানুষকে শিখিয়েছে কৃত্রিম বীজ ব্যবহার করার পথ। ফলে বৃষ্টি আর শুধু অলৌকিক ব্যাপার নয়; তা হয়ে ওঠে নিয়ম মেনে চলা এক প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া, যেখানে হস্তক্ষেপ সম্ভব, তবে সীমাবদ্ধতা মেনেই।
ইতিহাসের দিক থেকে দেখলে, বিশ্বের প্রথম কৃত্রিম বৃষ্টির কৃতিত্ব নির্দিষ্টভাবে কোনো বাঙালি বিজ্ঞানীর নামে লেখা নেই। কিন্তু এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে কসমিক রে, আয়নায়ন আর মেঘগঠনের পদার্থবিদ্যায় বাঙালিদের অবদান ভারতীয় আবহাওয়া বিজ্ঞানের ভিত মজবুত করেছে। এই মানসিকতাই ছিল আসল অর্জন—প্রকৃতিকে অনুভব করার পাশাপাশি তাকে বৈজ্ঞানিকভাবে বোঝার সাহস।
আজ জলবায়ু পরিবর্তন, খরা আর অনিয়মিত বর্ষণের যুগে দাঁড়িয়ে ওই গবেষণার গুরুত্ব আরও বেড়েছে। আধুনিক স্যাটেলাইট, ডপলার রাডার আর সুপারকম্পিউটার দিয়ে আমরা এখন মেঘের গতিপথ ও ভাঙনের সূক্ষ্ম মানচিত্র আঁকতে পারছি। কিন্তু এই আধুনিক ব্যবস্থার তলায় যে তাত্ত্বিক ভিত্তি—তা গড়ে উঠেছিল বহু বছর আগে, আয়নায়ন আর কসমিক কণার সেই প্রাথমিক পাঠ থেকেই।
এই গল্প তাই শুধুই অতীতের সাফল্যের দলিল নয়। এটি ভবিষ্যতের দিকেও ইঙ্গিত দেয়। যে আকাশে একদিন বাঙালি গবেষকেরা প্রথম ধরেছিলেন অদৃশ্য কণার ভেজা চিহ্ন, সেই আকাশেই হয়তো আগামী দিনে জন্ম নেবে আরও বিজ্ঞানসম্মত, জলবায়ু-বান্ধব বৃষ্টিনিয়ন্ত্রণের নতুন অধ্যায়। মেঘ আর বৃষ্টির প্রতি বাঙালির আবেগ তখনও থাকবে, তবে তার সঙ্গে যুক্ত হবে গভীর বৈজ্ঞানিক বোঝাপড়া—আকাশকে ভালোবাসার মতোই, তাকে বুঝে নেওয়ার অঙ্গীকার।






[…] […]