75 years of Howrah Bridge: কলকাতার প্রাণকেন্দ্র গঙ্গার ওপর স্থাপিত হাওড়া ব্রিজ (রবীন্দ্র সেতু) আজ ৭৫ বছর পেরিয়ে এক অনন্য স্থাপত্যের উদাহরণ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এই ব্রিজ শুধু একটি যাতায়াতের পথ নয়, এটি কলকাতার ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং জীবনযাত্রার অঙ্গ হয়ে উঠেছে। ১৯৪৩ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি, ভারতের স্বাধীনতার কিছু আগেই এই সেতুটি জনসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছিল, এবং তখন থেকেই এটি কলকাতার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সংযোগস্থল হয়ে উঠেছে।
নির্মাণের ইতিহাস ও স্থাপত্য (75 years of Howrah Bridge)
হাওড়া ব্রিজের নির্মাণ শুরু হয় ১৯৩৬ সালে, ব্রিটিশ শাসনের সময়। ব্রিজটি নির্মাণ করতে খরচ হয় প্রায় ২৫ কোটি টাকা, যা তখনকার সময়ে একটি বিরাট অংক ছিল। এর স্থাপত্য শৈলীটি ছিল ক্যান্টিলিভার ব্রিজ, যা তৎকালীন বিশ্বের অন্যতম বড় ক্যান্টিলিভার ব্রিজ হিসেবে গন্য করা হত। এই ব্রিজের দৈর্ঘ্য ১৫০০ ফুট এবং প্রস্থ ৭১ ফুট, যা গঙ্গা নদীর দুই তীরে কলকাতা এবং হাওড়াকে সংযুক্ত করে। এটি সম্পূর্ণভাবে লোহা এবং ইস্পাত দিয়ে তৈরি, এবং নির্মাণে প্রায় ২৬,৫০০ টন ইস্পাত ব্যবহার করা হয়েছিল, যার বেশিরভাগই তৎকালীন টাটার তৈরি।
প্রযুক্তির চমক:
হাওড়া ব্রিজের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হল এর নির্মাণে কোনো নাটবল্টু ব্যবহার করা হয়নি। এর পরিবর্তে পুরো ব্রিজটি রিভেটিং নামে একটি বিশেষ প্রযুক্তি দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। এছাড়া, সেতুটির স্থায়িত্ব ও ভারসাম্য রক্ষার জন্য এর নিচে দুটি বিরাট স্তম্ভ রয়েছে, যা গঙ্গার জলে দৃঢ়ভাবে স্থাপিত। ব্রিজটি এতটাই দৃঢ় যে, প্রতি বছর প্রায় এক লাখ যানবাহন এবং কয়েক লাখ পথচারী এর উপর দিয়ে যাতায়াত করে, তবুও এটি কোনো ধরনের ক্ষতি ছাড়াই দাঁড়িয়ে আছে।
অর্থনৈতিক গুরুত্ব:
হাওড়া ব্রিজ কেবল কলকাতা এবং হাওড়ার মধ্যে যাতায়াতের মাধ্যম নয়, এটি ভারতের পূর্বাঞ্চলের অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ সেতু হিসেবেও বিবেচিত হয়। প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ মানুষ এই সেতুর উপর দিয়ে যাতায়াত করে, যা কলকাতার বাণিজ্যিক কেন্দ্রের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে। এটি হাওড়া রেলওয়ে স্টেশনের সাথে কলকাতার কেন্দ্রকে সংযুক্ত করে, যা পূর্ব ভারতের অন্যতম প্রধান পরিবহন কেন্দ্র।
সাংস্কৃতিক প্রভাব:
কলকাতার মানুষদের জীবনের সাথে হাওড়া ব্রিজের একটি গভীর সংযোগ রয়েছে। এটি বাঙালি সংস্কৃতির একটি প্রতীক হয়ে উঠেছে, যা বহু কবিতা, গান, চলচ্চিত্র এবং সাহিত্যে স্থান পেয়েছে। সত্যজিৎ রায়ের “প্রতিদ্বন্দ্বী” থেকে শুরু করে বহু বাংলা এবং হিন্দি সিনেমায় হাওড়া ব্রিজকে কেন্দ্রীয় স্থান হিসেবে দেখা গেছে। এছাড়া, এটি কলকাতার ঐতিহ্যের একটি নিদর্শন হয়ে আছে, যা শহরের পুরনো ও নতুন প্রজন্মের মধ্যে একটি সংযোগ তৈরি করে।
চ্যালেঞ্জ ও রক্ষণাবেক্ষণ:
৭৫ বছর ধরে হাওড়া ব্রিজ শুধুমাত্র প্রাকৃতিক বিপর্যয় নয়, বরং মানবসৃষ্ট চ্যালেঞ্জেরও সম্মুখীন হয়েছে। গঙ্গার জলস্তর বৃদ্ধি, বন্যা, এবং প্রতিনিয়ত যানবাহনের ভার এই সেতুর স্থায়িত্বের ওপর প্রভাব ফেলেছে। তবে, নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ এবং মেরামতের মাধ্যমে এই ব্রিজটি এখনও অটুট রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পূর্ত বিভাগ এবং কলকাতা পোর্ট ট্রাস্ট নিয়মিতভাবে ব্রিজটির রক্ষণাবেক্ষণ করে, যাতে এটি আরও বহু বছর ধরে শহরের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে টিকে থাকতে পারে।
ভবিষ্যতের পরিকল্পনা: (75 years of Howrah Bridge)
হাওড়া ব্রিজের ৭৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে রাজ্য সরকার এবং কলকাতা পোর্ট ট্রাস্ট ব্রিজের রক্ষণাবেক্ষণ ও সৌন্দর্যায়নের জন্য বিশেষ পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। নতুন আলো এবং ডেকোরেশন ব্যবস্থা ব্রিজটির সৌন্দর্য আরও বৃদ্ধি করবে। পাশাপাশি, ব্রিজটির ইতিহাস এবং গুরুত্ব তুলে ধরতে পর্যটকদের জন্য বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যাতে নতুন প্রজন্ম এই স্থাপত্যের মূল্য উপলব্ধি করতে পারে।
উপসংহার:
হাওড়া ব্রিজ শুধুমাত্র একটি সেতু নয়, এটি কলকাতার ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং অর্থনীতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। ৭৫ বছর ধরে এই ব্রিজ তার স্থাপত্যের গৌরব, ইতিহাসের সাক্ষী এবং সাংস্কৃতিক প্রতীক হিসেবে কলকাতার মানুষদের সাথে রয়েছে। যতদিন কলকাতা থাকবে, ততদিন হাওড়া ব্রিজ তার জৌলুস নিয়ে গঙ্গার ওপর দাঁড়িয়ে থাকবে, গঙ্গার স্রোতে ভাসতে থাকবে। এটি শুধুমাত্র অতীতের নয়, ভবিষ্যতেরও একটি প্রতীক, যা সময়ের সাথে সাথে আরও গৌরবান্বিত হবে।
আরও পড়ুন: পঞ্চাশ পেরিয়েও ফিট থাকুন: ব্যায়ামের মন্ত্র