Positive বার্তা (বাংলা)

A teamwork initiative of Enthusiastic people using Social Media Platforms

Homeব্লগসালুমারাদা থিম্মাক্কা: এক শতায়ু নারীর হাতে গড়ে ওঠা সবুজের সাম্রাজ্য

সালুমারাদা থিম্মাক্কা: এক শতায়ু নারীর হাতে গড়ে ওঠা সবুজের সাম্রাজ্য

Salumarada Thimmakka: একটি বটগাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে আছেন এক বৃদ্ধা নারী। চুলে পাক ধরেছে অনেক আগেই, শরীর নুয়ে এসেছে বয়সের ভারে, কিন্তু চোখে এখনও দীপ্তি। তিনি সালুমারাদা থিম্মাক্কা—ভারতের ‘বৃক্ষ-মাতা’, যাঁর জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে জড়িয়ে রয়েছে গাছ, মাটি, রোদ-বৃষ্টি আর এক বিশাল সবুজ স্বপ্ন।

নিঃসন্তান জীবনের বদলে সবুজ সন্তানের জন্ম

থিম্মাক্কার জন্ম কর্নাটকের তুমকুর জেলার গুব্বি তালুকের এক দরিদ্র পরিবারে। ছোট থেকেই নানা রকম প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই করতে হয়েছে তাঁকে। লেখাপড়ার সুযোগ না পেলেও জীবনের পাঠ তাঁকে অনেক কিছু শিখিয়েছে। বিয়ের পরও জীবনে আসে না মাতৃত্বের আনন্দ। সমাজের কটূ কথা, পরিবারের চাপ—সব মিলিয়ে যখন জীবন অসহ্য হয়ে উঠছিল, তখনই এক অভিনব সিদ্ধান্ত নেন তিনি ও তাঁর স্বামী চিন্না। সন্তান না হলেও তাঁরা ঠিক করলেন প্রকৃতিকে সন্তান হিসেবে গ্রহণ করবেন।

সেই ভাবনা থেকেই শুরু হয় বৃক্ষরোপণ অভিযান। গ্রামের বাড়ি থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরত্ব পর্যন্ত রাস্তার ধারে তাঁরা রোপণ করতে থাকেন বটগাছের চারা। প্রথমে মাত্র ১৫টি চারার মাধ্যমে শুরু হয় যাত্রা। সেগুলো নিজের হাতে জল দিয়ে, গোবর দিয়ে সার দিয়ে, কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে রক্ষা করতেন তাঁরা। দিনে দিনে সেই সংখ্যা পৌঁছে যায় ৩৮৪-তে। প্রতিটি গাছ হয়ে ওঠে তাঁদের কাছে একেকটি সন্তান।

“সালুমারাদা”—গাছের সারির নারী

এই বৃক্ষপ্রেম থেকেই তিনি পেলেন নতুন নাম—”সালুমারাদা”, যার অর্থ ‘গাছের সারি’। জন্মসূত্রে তিনি আলা মারাদা থিম্মাক্কা হলেও এখন সবাই তাঁকে চেনে তাঁর গাছ লাগানোর অনন্য পরিচয়ের মাধ্যমেই। এই নাম কেবল একটা বিশেষণ নয়, এটা একটি আন্দোলনের নাম, একটি অনুপ্রেরণার নাম।

সংগ্রামের জীবন ও আত্মবলিদান

একদিকে অর্থের অভাব, অন্যদিকে সমাজের কটূ বাক্য—এই দুইয়ের সঙ্গে লড়াই করে গেছেন থিম্মাক্কা। কোনো সরকারি সহায়তা, কোনো দাতব্য প্রতিষ্ঠান, কোনো এনজিও—কোনও কিছুর সাহায্য ছাড়াই তিনি ও তাঁর স্বামী নিজেদের সঞ্চয় এবং ঘাম দিয়ে গড়ে তুলেছেন এক সবুজ সাম্রাজ্য।

১৯৯১ সালে স্বামী মারা গেলে থিম্মাক্কা একা হয়ে পড়েন। তবে তিনি থেমে যাননি। একার হাতে চালিয়ে গেছেন বৃক্ষরোপণ, যত্ন ও সচেতনতামূলক কার্যক্রম। তাঁর রোপণ করা গাছের সংখ্যা আজ ৮,০০০ ছাড়িয়েছে, যার মধ্যে বহু ফলজ, ঔষধি ও ছায়াদানকারী গাছ রয়েছে।

সবুজের জন্য চোখের জল, সরকারের সিদ্ধান্ত বদল

২০১৯ সালে কর্নাটক সরকার হালাগুরু রোড সম্প্রসারণ প্রকল্পে থিম্মাক্কার রোপণ করা ৩৮৫টি বটগাছ কেটে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয়। খবরটি ছড়িয়ে পড়তেই দেশজুড়ে সমালোচনার ঝড় ওঠে। এক শতায়ু বৃক্ষমাতার কষ্টের ফসল নষ্ট হতে চলেছে দেখে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে পরিবেশপ্রেমীরা সকলে সরব হন। শেষ পর্যন্ত সরকারের পক্ষ থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়—গাছগুলি রক্ষা করা হবে।

এই ঘটনা আবারও প্রমাণ করে দেয়, এক নারীর ভালোবাসা ও দৃঢ়তার কাছে প্রশাসনিক সিদ্ধান্তও মাথা নোয়ায়।

সম্মান, পুরস্কার ও মানুষের ভালোবাসা

থিম্মাক্কা পেয়েছেন বহু সম্মান ও পুরস্কার। ২০১৯ সালে তিনি পদ্মশ্রী সম্মানে ভূষিত হন। এ ছাড়াও তাঁকে দেওয়া হয়েছে রাষ্ট্রপতি পুরস্কার, ইন্দিরা প্রিয়দর্শিনী বৃক্ষবন্ধু পুরস্কার, জাতিসংঘ পরিবেশ সংস্থা থেকে স্বীকৃতি এবং অন্যান্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সম্মান।

তাঁর সম্পত্তির পরিমাণ আজ কোটি টাকার ওপরে। কিন্তু তাঁর জীবনযাত্রা এখনও সহজ-সরল, মাটির কাছেই। শহরের আলিশান ফ্ল্যাট নয়, তিনি এখনও থাকেন গাছের ছায়াতেই। তাঁর অক্সিজেন যেন সেই সবুজ সন্তানের ভালোবাসাতেই মিশে আছে।

বিশ্ববাসীর জন্য এক বার্তা

আজ যখন জলবায়ু পরিবর্তন ভয়ঙ্কর রূপ নিচ্ছে, পৃথিবীর বুকে গাছ কমে যাচ্ছে, প্রাকৃতিক দুর্যোগ বেড়ে চলেছে—তখন থিম্মাক্কার জীবন যেন এক জ্যান্ত বার্তা হয়ে ওঠে।

তিনি বলতেন, “গাছ মানেই জীবন। একটি গাছ মানেই শত প্রাণ। বাঁচাও গাছ, বাঁচবে মানুষ।”

পরিবেশ রক্ষা কেবল সরকারের কাজ নয়, এটা আমাদের প্রত্যেকের দায়িত্ব। থিম্মাক্কার জীবন আমাদের শেখায়—একজন সাধারণ মানুষও অসাধারণ পরিবর্তন আনতে পারেন।

সবুজের পূজারিণী, পৃথিবীর আসল নায়িকা

বিশ্ব পরিবেশ দিবসে যাঁদের কথা মনে পড়া উচিত, তাঁদের মধ্যে শীর্ষে থাকবেন সালুমারাদা থিম্মাক্কা। তিনি শুধু একজন বৃক্ষরোপণকারী নন, তিনি প্রকৃতির এক নিঃশব্দ যোদ্ধা, সবুজের পূজারিণী।

তার জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত আমাদের নতুন করে ভাবতে শেখায়—আমরা কিভাবে পৃথিবীকে বাসযোগ্য রাখবো ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য। তাঁর গাছগুলো শুধু ছায়া দেয় না, দেয় শিক্ষা, ভালোবাসা আর নতুন করে বাঁচার আশা।

শেষ কথা:
সালুমারাদা থিম্মাক্কার মতো মানুষের কাছে আমাদের বারবার ফিরে আসা উচিত। তাঁরা প্রমাণ করেন—সত্যিকারের ভালোবাসা ও আত্মত্যাগ কোনো বড় পদ বা ডিগ্রির মোহে তৈরি হয় না। তৈরি হয় হৃদয়ের গভীর থেকে।

সালুমারাদা থিম্মাক্কা—তিনি শুধুই একজন বৃক্ষমাতা নন, তিনি গোটা মানবজাতির আশার বাতিঘর। 🌳🌍💚

আরও পড়ুন: শিবপুর সেতুর উদ্বোধন: দুর্গাপুর ও বীরভূমের সংযোগে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়

Join Our WhatsApp Group For New Update
RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_img

সবচেয়ে জনপ্রিয়