Roaring Back: প্রতি বছর ২৯ জুলাই বিশ্বব্যাপী পালিত হয় বিশ্ব ব্যাঘ্র দিবস (World Tiger Day)। এই দিনটির মূল উদ্দেশ্য হলো পৃথিবী থেকে ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হতে চলা রয়েল বেঙ্গল টাইগার তথা বাঘের অস্তিত্ব রক্ষা করা এবং তার প্রাকৃতিক বাসস্থান সংরক্ষণের গুরুত্ব তুলে ধরা। বাঘ শুধু একটি প্রাণী নয়, এটি একটি পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষাকারী প্রাণী এবং জৈববৈচিত্র্যের প্রতীক। এই বিশেষ দিনে ভারতের ভূমিকা অনস্বীকার্য—কারণ বর্তমানে বিশ্বে যত বাঘ বেঁচে আছে, তার প্রায় ৭৫ শতাংশই রয়েছে ভারতের বিস্তীর্ণ বাঘ সংরক্ষণ অঞ্চলে।
ভারতের বাঘ সংরক্ষণের ইতিহাস: সংকট থেকে সংগ্রাম, সংগ্রাম থেকে সাফল্য
এক সময় ভারতের বনে বনে ঘুরে বেড়াত হাজার হাজার বাঘ। কিন্তু ১৯০০ সালের শুরুতে শিকার, বন উজাড় ও অবৈধ পাচারের ফলে বাঘের সংখ্যা ভয়াবহভাবে কমতে থাকে। ১৯৭৩ সালে ভারত সরকার এক ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নেয় — ‘প্রজেক্ট টাইগার’ (Project Tiger) চালু করা হয় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বে। এই প্রকল্পের মূল লক্ষ্য ছিল বাঘ সংরক্ষণ এবং তাদের প্রাকৃতিক আবাসস্থল রক্ষা করা।
১৯৭৩ সালে যখন প্রকল্পটি শুরু হয়, তখন দেশে মাত্র ৯টি টাইগার রিজার্ভ ছিল। বর্তমানে এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৬টি টাইগার রিজার্ভে, যা ১৮টি রাজ্যে বিস্তৃত। একসময় যেখানে দেশের বাঘের সংখ্যা ১,৪১১ তে নেমে গিয়েছিল, এখন সেখানে ২০২৩ সালের গণনায় ভারতের বাঘের সংখ্যা ৩,৬৮২, যা এক ঐতিহাসিক রেকর্ড।
বিশ্বের বৃহত্তম বাঘের আবাসস্থল: ভারত
ভারত একমাত্র দেশ যেখানে এত বড় মাত্রায় সরকার, বিজ্ঞানী, বনদপ্তর, স্থানীয় জনগণ এবং স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলি একযোগে কাজ করে গেছে বাঘ রক্ষায়। মধ্যপ্রদেশ, কর্ণাটক, উত্তরাখণ্ড, মহারাষ্ট্র, আসাম, তামিলনাড়ু—এই রাজ্যগুলি বাঘ সংরক্ষণে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছে। মধ্যপ্রদেশকে বর্তমানে ‘টাইগার স্টেট অব ইন্ডিয়া’ বলা হয়, কারণ এখানেই সর্বাধিক বাঘের বসবাস।
প্রসঙ্গত, মধ্যপ্রদেশের কানহা, পেনচ, বান্ধবগড়, সাতপুরা, কর্ণাটকের নাগারহোলে ও বান্দিপুর, উত্তরাখণ্ডের করবেট, এবং মহারাষ্ট্রের তাদোবা টাইগার রিজার্ভ বিশ্বব্যাপী খ্যাতি অর্জন করেছে সফল বাঘ সংরক্ষণের মডেল হিসেবে।
প্রযুক্তির সহায়তায় সংরক্ষণে নতুন দিশা
বাঘ সংরক্ষণের ক্ষেত্রে ভারত গত কয়েক বছরে অত্যন্ত আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু করেছে। ক্যামেরা ট্র্যাপ, জিপিএস কলার, ড্রোন নজরদারি, ডেটা অ্যানালিটিকস, এবং AI-ভিত্তিক বাঘ ট্র্যাকিং সফটওয়্যার ব্যবহার করে বাঘের গতিবিধি নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করা হয়।
জাতীয় স্তরে ‘ন্যাশনাল টাইগার কনজারভেশন অথরিটি (NTCA)’ এবং ‘ওয়াইল্ডলাইফ ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়া (WII)’ একত্রে পরিচালনা করছে একটি শক্তিশালী মনিটরিং ব্যবস্থা, যার মাধ্যমে প্রতি চার বছর অন্তর বাঘ গণনা করা হয় এবং তা আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী প্রস্তুত করা হয়।
জনগণের ভূমিকা ও স্থানীয় অংশগ্রহণ
বাঘ সংরক্ষণ শুধু সরকারের একক দায়িত্ব নয়। ভারতের বহু অঞ্চলে স্থানীয় জনগোষ্ঠীও সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। অনেক আদিবাসী সম্প্রদায় বনজীবী হলেও, তারা এখন বাঘ সংরক্ষণের স্বার্থে বন বিভাগের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করছেন। ইকো-ট্যুরিজম চালু করে তাদের বিকল্প জীবিকা প্রদান করা হচ্ছে। এর ফলে একদিকে যেমন বাঘের ওপর নির্ভরতা কমছে, অন্যদিকে জীববৈচিত্র্য রক্ষা পাচ্ছে।
আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও ভারতের নেতৃত্ব
ভারতের বাঘ সংরক্ষণ মডেল এখন আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত। ২০১০ সালে রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গে অনুষ্ঠিত ‘টাইগার সামিট’-এ বিশ্বের ১৩টি বাঘ-বসবাসকারী দেশ TX2 লক্ষ্য ঘোষণা করে, যার উদ্দেশ্য ছিল ২০২২ সালের মধ্যে বাঘের সংখ্যা দ্বিগুণ করা। ভারত সেই লক্ষ্য পূরণ করেছে অনেক আগেই—২০১৮ সালেই দেশের বাঘ সংখ্যা দ্বিগুণ হয় ২০০৬ সালের তুলনায়।
ভারত এখন অন্যান্য দেশকে প্রযুক্তিগত সহায়তা, পরামর্শ এবং প্রশিক্ষণ দিচ্ছে—যেমন নেপাল, ভুটান, বাংলাদেশ ও কম্বোডিয়া। এইভাবে ভারতের নেতৃত্ব আন্তর্জাতিক বাঘ সংরক্ষণের মঞ্চেও সুপ্রতিষ্ঠিত।
ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ: জলবায়ু পরিবর্তন ও বন উজাড়
তবে সব কিছুর মধ্যেও চ্যালেঞ্জ থেকে যাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তন, নদী শুকিয়ে যাওয়া, শুষ্ক মরশুমের বিস্তার, বনাঞ্চলের খণ্ডিত রূপ, রাস্তা বা রেললাইন নির্মাণ, মানুষ-বাঘ সংঘর্ষ—এইসব বিষয়গুলি বাঘ সংরক্ষণের ভবিষ্যতে বড় হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে। তাই এখন প্রয়োজন আরও সচেতনতা, দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা, বিজ্ঞানভিত্তিক নীতিমালা এবং স্থানীয় অংশগ্রহণ।
শুধু সংরক্ষণ নয়, সম্মানও জরুরি
বিশ্ব ব্যাঘ্র দিবসে আমরা সবাই যেন মনে রাখি—বাঘ শুধু একটি প্রাণী নয়, এটি একটি প্রজাতির প্রতিনিধি, একটি বাস্তুতন্ত্রের মূলস্তম্ভ। ভারতের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশ যেখানে জনসংখ্যার চাপ এবং শিল্পায়নের গতি অত্যন্ত বেশি, সেখানে এত সফলভাবে বাঘ সংরক্ষণ সত্যিই এক অনন্য দৃষ্টান্ত। এই সাফল্য কেবল বন দপ্তর বা সরকারের নয়, প্রতিটি সচেতন নাগরিকের।
তাই আসুন, এই বিশ্ব ব্যাঘ্র দিবসে আমরা প্রতিজ্ঞা করি—আমরা শুধু বাঘ সংরক্ষণ করব না, তার বাসস্থান, তার অধিকার এবং তার মহিমাকেও সম্মান জানাবো।
📌 বিশেষ তথ্যচিত্র: ভারতের উল্লেখযোগ্য টাইগার রিজার্ভ সমূহ
টাইগার রিজার্ভ | রাজ্য | বিখ্যাত বৈশিষ্ট্য |
---|---|---|
কানহা | মধ্যপ্রদেশ | ইন্সপিরেশন ফর “Jungle Book” |
করবেট | উত্তরাখণ্ড | ভারতের প্রথম ন্যাশনাল পার্ক |
বান্ধবগড় | মধ্যপ্রদেশ | সর্বাধিক বাঘ ঘনত্ব |
সুন্দরবন | পশ্চিমবঙ্গ | ম্যানগ্রোভে বসবাসকারী রয়েল বেঙ্গল টাইগার |
তাদোবা | মহারাষ্ট্র | দ্রুত বৃদ্ধি পাওয়া টাইগার পপুলেশন |
🌿 “যতদিন বাঘ থাকবে, ততদিন বনের ভারসাম্য থাকবে। বাঘ হারালে হারাবে শুধু একটি প্রাণী নয়—একটি প্রকৃতি, একটি ইতিহাস।” 🌿
আরও পড়ুন: শিবপুর ব্রিজের দ্বারোদ্ঘাটন: অজয় নদের তীরে এক নতুন ভোরের সূচনা!