QR Code: প্রযুক্তির এই দুনিয়ায় প্রতিদিনই অসংখ্য নতুন উদ্ভাবন আমাদের জীবনকে বদলে দিচ্ছে। তবে সব আবিষ্কার সমানভাবে মানুষের কাছে পৌঁছায় না। কারও উদ্ভাবন সীমাবদ্ধ থেকে যায় পেটেন্টের গণ্ডিতে, আবার কারও উদ্ভাবন হয়ে ওঠে মানুষের প্রতিদিনের জীবনের অপরিহার্য অংশ। এমনই এক চমকপ্রদ উদাহরণ হলো QR কোড। আজকের দিনে মোবাইল ফোন ব্যবহারকারী এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া কঠিন, যিনি অন্তত একবারও QR কোড ব্যবহার করেননি। অথচ এই উদ্ভাবনের পেছনে রয়েছে এক অনন্য আত্মত্যাগ ও মানবকল্যাণের গল্প।
আবিষ্কারের জন্মকথা
১৯৯৪ সাল। জাপানের গাড়ি শিল্প তখন প্রযুক্তিগতভাবে দ্রুত এগোচ্ছে। গাড়ির যন্ত্রাংশ তৈরির সময় দ্রুত ও নির্ভুলভাবে তথ্য স্ক্যান করার প্রয়োজন দেখা দেয়। সাধারণ বারকোড তখন ব্যবহৃত হলেও, সেটি একমাত্র সীমিত তথ্য বহন করতে পারত এবং স্ক্যানিং প্রক্রিয়াও ধীরগতির ছিল। ঠিক তখনই ডেনসো ওয়েভ নামের এক জাপানি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত প্রকৌশলী মাসাহিরো হারা ভাবলেন, এমন কিছু তৈরি করতে হবে যা একসঙ্গে অনেক তথ্য বহন করতে পারবে এবং মুহূর্তেই স্ক্যান করা যাবে।
এই ভাবনা থেকেই জন্ম নিল কুইক রেসপন্স কোড, সংক্ষেপে QR কোড। প্রথমে এটি কেবলমাত্র গাড়ির যন্ত্রাংশ দ্রুত স্ক্যান করার জন্য তৈরি হয়েছিল। এর ব্লক বা ডটের বিন্যাস এতটাই নির্ভুল যে একবার স্ক্যান করলেই পুরো তথ্য তাৎক্ষণিকভাবে উঠে আসে।
নিঃস্বার্থতার পরিচয়
যেখানে অনেক আবিষ্কারক তাদের আবিষ্কারকে বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার করে কোটি কোটি টাকা আয় করেন, সেখানে মাসাহিরো হারা এক ভিন্ন পথ বেছে নিলেন। তিনি QR কোডকে নিজের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেননি। বরং তিনি এটি সবার জন্য উন্মুক্ত করে দিলেন। যে কেউ, যে কোনো প্রতিষ্ঠান এই প্রযুক্তি ব্যবহার করতে পারল বিনামূল্যে।
এই সাহসী ও মানবিক সিদ্ধান্তই QR কোডকে জনপ্রিয় করে তুলেছে। যদি এটি কেবলমাত্র একটি কোম্পানির হাতে সীমাবদ্ধ থাকত, তবে হয়তো আজ QR কোড এই পরিমাণে বিস্তার লাভ করতে পারত না। মাসাহিরো হারার এই পদক্ষেপই প্রমাণ করে, সত্যিকারের উদ্ভাবক সেই, যিনি মানুষের জীবনের সুবিধাকে নিজের লাভের ওপরে স্থান দেন।
প্রযুক্তির বিবর্তনে QR কোডের ভূমিকা
আজ QR কোড শুধু গাড়ির যন্ত্রাংশ নয়, আমাদের দৈনন্দিন জীবনের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে উপস্থিত।
- ডিজিটাল পেমেন্ট: নগদ টাকার ঝামেলা ছাড়াই আমরা দোকানে, বাজারে, এমনকি রাস্তায় ভ্যানগাড়িতেও QR কোড স্ক্যান করে টাকা পরিশোধ করি।
- টিকিট বুকিং: ট্রেন, বাস কিংবা সিনেমা—সব জায়গায় QR কোড টিকিট ব্যবস্থাকে করেছে আরও সহজ ও দ্রুত।
- স্বাস্থ্যসেবা: হাসপাতাল বা মেডিক্যাল স্টোরে রোগীর তথ্য সংরক্ষণ ও ওষুধের সত্যতা যাচাইয়ে QR কোড ব্যবহার হচ্ছে।
- শিক্ষা: বইয়ের ভেতরে QR কোড স্ক্যান করে শিক্ষার্থীরা ভিডিও লেকচার, নোটস কিংবা অতিরিক্ত তথ্য পাচ্ছে সহজেই।
- প্রচার ও বিপণন: পোস্টার, ব্যানার বা বিজ্ঞাপনে একটি QR কোড থাকলেই মানুষ সরাসরি ওয়েবসাইট, অফার বা অ্যাপ ডাউনলোড লিংকে পৌঁছে যাচ্ছে।
অর্থাৎ, QR কোড এখন কেবল একটি প্রযুক্তি নয়, এটি হয়ে উঠেছে একটি সেতু, যা বাস্তব জগত ও ডিজিটাল জগতকে যুক্ত করছে।
মহামারীর সময়ে QR কোডের উত্থান
২০২০ সালে করোনাভাইরাস মহামারী যখন পুরো বিশ্বকে স্তব্ধ করে দিয়েছিল, তখন মানুষ স্পর্শহীন সমাধানের খোঁজ করছিল। ঠিক তখনই QR কোড যেন এক নতুন প্রাণ পেল। রেস্টুরেন্টে মেনু কার্ড থেকে শুরু করে হাসপাতালের রিপোর্ট—সব জায়গায় QR কোড হয়ে উঠল নিরাপদ বিকল্প।
কোনো কিছু স্পর্শ না করেই কেবলমাত্র মোবাইল ক্যামেরা দিয়ে কোড স্ক্যান করে পাওয়া যাচ্ছিল প্রয়োজনীয় তথ্য। এটি শুধু প্রযুক্তিগত সুবিধাই নয়, বরং মানুষের জীবন রক্ষায়ও ভূমিকা রেখেছিল।
QR কোডের ভবিষ্যৎ
আজ QR কোড শুধু একটি কালো-সাদা ডটের বিন্যাস নয়, বরং একটি গ্লোবাল ল্যাঙ্গুয়েজ। ভবিষ্যতে এটি আরও আধুনিক রূপ নেবে বলে বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন। ইতিমধ্যেই রঙিন QR কোড, ডিজাইন করা ব্র্যান্ডেড QR কোড এবং সুরক্ষিত এনক্রিপ্টেড কোড বাজারে এসেছে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও ব্লকচেইন প্রযুক্তির সঙ্গে যুক্ত হয়ে QR কোড হতে পারে আরও নিরাপদ, নির্ভরযোগ্য ও কার্যকর।
মাসাহিরো হারার শিক্ষা
মাসাহিরো হারার আবিষ্কার আমাদের একটি বড় শিক্ষা দেয়—নিঃস্বার্থতা ও মানবকল্যাণই প্রকৃত অগ্রগতির চাবিকাঠি। QR কোড যদি শুধু বাণিজ্যিক স্বার্থে সীমাবদ্ধ থাকত, তবে কোটি কোটি মানুষ এর সুবিধা পেত না।
আজ আমরা যখন দোকানে দাঁড়িয়ে একটি QR কোড স্ক্যান করি বা হাসপাতালের কাউন্টারে স্বাস্থ্য রিপোর্ট পাই, তখন হয়তো আমরা বুঝতে পারি না এর পেছনের আত্মত্যাগের গল্প। কিন্তু এই গল্প প্রমাণ করে, একজন মানুষের সিদ্ধান্ত গোটা বিশ্বের জীবনধারা বদলে দিতে পারে।
QR কোড কেবল একটি প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন নয়, এটি মানবিকতার প্রতীক। মাসাহিরো হারার মতো একজন প্রকৌশলীর নিঃস্বার্থ চিন্তা বিশ্বকে দেখিয়ে দিয়েছে, কিভাবে একটি ছোট্ট আবিষ্কার কোটি কোটি মানুষের জীবন সহজ করে দিতে পারে।
আজকের এই ডিজিটাল যুগে যখন আমরা প্রতিদিন QR কোড ব্যবহার করছি, তখন হয়তো আমাদের একবার হলেও মনে রাখা উচিত—এই কোডের ভেতরে লুকিয়ে আছে এক মানুষের অগাধ মানবপ্রেম, যিনি লাভের চিন্তা না করে পৃথিবীকে দিলেন এক অমূল্য উপহার।
আরও পড়ুন: নীরবে সেবাদানকারীদের সম্মান: পাঁড়ুইয়ের সাত্তোরে ‘পাড়া শক্তি গুণী শক্তি সম্মান’
 
 

