From Fiction to Summit: নদিয়ার করিমপুর থেকে আফ্রিকার মার্গারিটা শৃঙ্গে, সাহসিকতার পথে সাহিত্যপ্রেমের এক বিরল নিদর্শন তৈরি করলেন জ্যোতিষ্ক বিশ্বাস। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘চাঁদের পাহাড়’ উপন্যাসে কল্পনার যে অভিযান শুরু হয়েছিল, তা বাস্তবের মাটিতে রূপ পেল এই বাঙালি তরুণের নির্ভীক পদক্ষেপে।
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম এক অনন্য উচ্চতায় অবস্থান করছে। তাঁর সৃষ্টি ‘চাঁদের পাহাড়’ শুধু একটি উপন্যাস নয়, বহু বাঙালির কল্পনার অ্যাডভেঞ্চার-ডায়েরি। সাহস, স্বপ্ন আর অনন্ত অভিযানের মিশেল এই কাহিনীতে বহু কিশোর তাদের প্রথম অভিযাত্রী স্বপ্ন দেখেছিল। আর সেই স্বপ্নকেই বাস্তবে রূপ দিলেন করিমপুরের যুবক জ্যোতিষ্ক বিশ্বাস।
✦ শংকরের পথে বাস্তবের অভিযাত্রী
‘চাঁদের পাহাড়’-এর কেন্দ্রীয় চরিত্র শংকর এক তরুণ রেলকর্মী, যিনি আফ্রিকার বুনো অরণ্য পেরিয়ে ছুটে চলেন এক রোমাঞ্চকর অভিযানে। অজানা গন্তব্য, অজানা পথ, কিন্তু এক অদম্য আকাঙ্ক্ষা তাঁর প্রেরণা। আজ, সেই কল্পিত অভিযানের একশো বছর পর, বাস্তবে শংকরের পথ অনুসরণ করে সাহিত্যের প্রতি শ্রদ্ধার নিদর্শন রাখলেন জ্যোতিষ্ক।
জ্যোতিষ্কের বক্তব্য, “ছেলেবেলায় ‘চাঁদের পাহাড়’ পড়ে আমি শুধু রোমাঞ্চিত হইনি, আমার মনের মধ্যে জন্ম নিয়েছিল এক দুঃসাহসী যাত্রার স্বপ্ন। সেই স্বপ্ন আজ বাস্তব হয়েছে।”
✦ যাত্রার সূচনা: সাহস, সাইকেল আর সাধনা
জ্যোতিষ্ক বিশ্বাসের বেড়ে ওঠা নদিয়ার করিমপুরের জামতলায়। তাঁর বাবা ছিলেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর সদস্য। ছোটবেলা থেকেই বিভিন্ন রাজ্যে ঘুরে বেড়ানো, প্রকৃতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা, আর সাহসিকতার গল্পের প্রতি আগ্রহ তাঁকে তৈরি করেছে অন্যভাবে। বিশেষ করে সাইকেল চালানো তাঁর প্যাশন হয়ে দাঁড়ায়, যা পরবর্তীতে অভিযানের প্রধান সঙ্গী হয়ে ওঠে।
২০২৪ সালের জুন মাসে, সম্পূর্ণ স্বনির্ভর অর্থে ও পরিকল্পনায় তিনি পাড়ি দেন আফ্রিকার দিকে। তাঁর লক্ষ্য — রোয়েনজোরি পর্বতমালার সর্বোচ্চ শৃঙ্গ ‘মার্গারিটা পিক’ (৫,১০৯ মিটার)। বাংলা সাহিত্যের পাঠকের কাছে যেটি চিরকাল ‘চাঁদের পাহাড়’ নামে পরিচিত।
✦ এক শতাব্দীর ব্যবধান: সাহিত্য ও বাস্তবতার অসাধারণ মেলবন্ধন
বিশেষ চমকপ্রদ বিষয় হল, বিভূতিভূষণের উপন্যাসে শংকর যেখান থেকে যাত্রা শুরু করেন — কেনিয়ার বোম্বাসা রেল হেড অফিস — জ্যোতিষ্ক ঠিক সেই স্থান থেকেই অভিযান শুরু করেন। যেন শতবর্ষ পরে সাহিত্য আর বাস্তবতার মাঝে তৈরি হল এক সেতুবন্ধন, যা কেবল সময়কে অতিক্রম করেই নয়, একটি সংস্কৃতির গর্ব হিসেবেও চিহ্নিত হল।
✦ অভিযানপথে অভিজ্ঞতা: প্রকৃতির সৌন্দর্য ও সংকটের সমন্বয়
জ্যোতিষ্কের এই অভিযাত্রা কোনও বিলাসী পর্যটন নয়, বরং ছিল প্রকৃত দুঃসাহসিক অভিযানের প্রতীক। কেনিয়া, তানজানিয়া, উগান্ডার নানা দুর্গম পথ অতিক্রম করে, পাহাড়, জঙ্গল, নদী পেরিয়ে এগিয়ে চলেছেন তিনি। এই যাত্রাপথে দেখা মিলেছে নানা রকম অভিজ্ঞতার — কিছু আনন্দদায়ক, কিছু চরম ভয়ঙ্কর।
তাঁর ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্টে দেখা যায় রোমহর্ষক ছবি ও ভিডিও — যেমন উগান্ডার বনে মানুষখেকো বাঘের পদচিহ্ন, কিংবা স্থানীয় গ্রামবাসীদের সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়া একটি পাহাড়ি রাতে আগুন জ্বালিয়ে রাখার গল্প।
তিনি বলেন, “এটি শুধু একটি শারীরিক চ্যালেঞ্জ নয়। প্রতিটি ধাপে ছিল মানসিক পরীক্ষাও। সাহস, একাগ্রতা, আর বিভূতিভূষণের প্রতি ভালোবাসা — এই তিনে মিলে পথ চলেছি।”
✦ চূড়ান্ত মুহূর্ত: শৃঙ্গ জয় ও শ্রদ্ধার নিদর্শন
অবশেষে জ্যোতিষ্ক পৌঁছালেন আফ্রিকার তৃতীয় সর্বোচ্চ শৃঙ্গ মার্গারিটা পিকে। তার হাতে ছিল বিভূতিভূষণের ‘চাঁদের পাহাড়’ উপন্যাস আর একখানি চিরকূট — যাতে লেখা ছিল:
“Tribute to Bibhutibhushan Bandyopadhyay”
এই চিরকূট যেন সময়ের সীমানা ছাড়িয়ে পৌঁছে যায় বিভূতিভূষণের পায়ের কাছে — পাঠকের তরফে এক চিরন্তন শ্রদ্ধার অর্ঘ্য।
✦ স্বপ্ন, সাহস ও সাহিত্যপ্রেমের মিলন
জ্যোতিষ্ক বিশ্বাসের এই যাত্রা বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় যুক্ত করল। একজন সাধারণ বাঙালি যুবকের পক্ষেও সাহিত্যকে কেন্দ্র করে এমন অসাধারণ উদ্যোগ যে সম্ভব, তা তিনি প্রমাণ করে দিলেন।
এই অভিযানের মধ্যে লুকিয়ে আছে এক বিশাল বার্তা — স্বপ্ন যদি সত্যি করতে হয়, তবে শুধু কল্পনা নয়, প্রয়োজন দৃঢ়সংকল্প, অধ্যবসায় ও সাহস। সাহিত্যের প্রতি ভালোবাসা মানুষকে কতদূর নিয়ে যেতে পারে, তার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত জ্যোতিষ্ক।
✦ সমাপ্তি নয়, এক নতুন সূচনা
জ্যোতিষ্কের মতে, “এই যাত্রা আমার জীবনের একটি অধ্যায় শেষ করল, কিন্তু শুরু করল আরেকটি। আমি চাই, আগামী প্রজন্ম সাহিত্যের অনুপ্রেরণাকে বাস্তবে রূপ দিক। সাহিত্য আমাদের কেবল স্বপ্ন দেখায় না — তার ভিতরেই লুকিয়ে থাকে আমাদের আত্মার পরিচয়।”
বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ ক্লাসিক ‘চাঁদের পাহাড়’ আজ আর শুধু একটি গল্প নয়। তা এখন জ্যোতিষ্ক বিশ্বাস নামের এক বাস্তব অভিযাত্রীর পদচিহ্নে রূপ নিয়েছে। সাহিত্যের প্রতি শ্রদ্ধা, সাহসিকতার প্রতি প্রতিশ্রুতি, আর বাঙালির আত্মবিশ্বাসের এক উজ্জ্বল অধ্যায় হয়ে থাকবে তাঁর এই কীর্তি।
এটাই প্রমাণ করে — সাহিত্যের জগত শুধু কল্পনার সীমায় আটকে নেই, তা বাস্তবেও ছুঁয়ে যায় পৃথিবীর সর্বোচ্চ চূড়া।
আরও পড়ুন: সুন্দরবন: বাঘ আর কুমিরের বাইরে এক ভিন্ন অভিজ্ঞতা – কুমিরমারীর গ্রামীণ জীবন
[…] […]