Asansol’s Namesake Tree: “নেই ‘আসান’ গাছের জলাভূমি, রুক্ষ আমার জন্মভূমি…” – আসানসোল শহর নিয়ে লেখা এই পংক্তিগুলো আজ এক তিক্ত সত্যের প্রতিধ্বনি। যে ‘আসান’ গাছের নামে এই ঐতিহাসিক শহরের নামকরণ, সেই গাছই আজ আসানসোল থেকে প্রায় বিলুপ্ত। ‘আসান+সোল’ অর্থাৎ ‘আসান’ গাছ সমৃদ্ধ মাটি বা জমি, এই সহজ অর্থেই পরিচিত হয়েছিল আসানসোল। কিন্তু কালের ফেরে, নগরায়ণ আর শিল্পায়নের করাল গ্রাসে হারিয়ে গেছে সেই পরিচিতি। তবে আশার আলো দেখাচ্ছে আসানসোলের বানোয়ারিলাল ভালোটিয়া (বিবি) কলেজ। তাদের যুগান্তকারী উদ্যোগে আবারও প্রাণ ফিরে পাচ্ছে আসানসোল তার নিজস্ব পরিচয়ে।
বিবি কলেজের বটানি বিভাগ এবং এনএসএস-এর ছাত্রছাত্রীদের অক্লান্ত পরিশ্রমে তৈরি হয়েছে প্রায় পাঁচ হাজার ‘আসান’ গাছের চারা। এই চারাগুলি আসানসোল শহরের বিভিন্ন প্রান্তে লাগানো হবে, যা নিঃসন্দেহে শহরের পরিবেশ এবং ঐতিহ্য সংরক্ষণে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
আসানসোলের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস ও ‘আসান’ গাছের বিলুপ্তি
আসানসোলের ইতিহাস বেশ সমৃদ্ধ। জনশ্রুতি অনুযায়ী, একদা ‘আসান’ গাছের জঙ্গল কেটে নকড়ি রায় ও রামকৃষ্ণ রায় নামের দুই শ্বশুর-জামাতা ‘আসানসোল গ্রাম’ প্রতিষ্ঠা করেন। যদিও তথ্য সংগ্রাহকরা আরও প্রাচীন জনবসতির কথা বলেন, তবু ‘আসান’ গাছের সঙ্গে এই অঞ্চলের গভীর সম্পর্ক অনস্বীকার্য।
পরবর্তীকালে, রানিগঞ্জের নারায়ণকুড়ি গ্রামে কয়লা উত্তোলন শুরু হলে প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের উদ্যোগে রেলপথ প্রসারিত হয় রানিগঞ্জ পর্যন্ত। এরপর তা আসানসোল পর্যন্ত এসে পৌঁছায় এবং ইস্ট ইন্ডিয়া রেল কোম্পানির রেল ডিভিশন এখানে স্থাপিত হয়। রেলপথ আসার পরেই আসানসোল শহরে আধুনিক নাগরিক সভ্যতার সূচনা হয়। ব্রিটিশ রেল কর্মচারী, আর্মেনীয় এবং অন্যান্য ব্যবসায়ীরা এখানে বসতি স্থাপন শুরু করেন।
অন্যদিকে, বার্নপুর ও কুলটিতে স্যার রাজেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় ও বীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের উদ্যোগে ইস্পাত শিল্প গড়ে উঠলে আসানসোল শিল্পাঞ্চল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এই রেল যোগাযোগ এবং শিল্পাঞ্চলের প্রসারের ফলে নির্বিচারে কাটা পড়ে বনাঞ্চল। চাকরির সন্ধানে আসা মানুষের বসতি স্থাপনের ফলে গ্রামের পর গ্রাম গড়ে ওঠে, বিলীন হয়ে যায় বনভূমি। আর এই অপরিকল্পিত উন্নয়নের বলি হয় ‘আসান’ গাছ, যা শহরের নিজস্ব নাম বহন করে।
‘আসন’ না ‘আসান’? বিতর্ক এবং সঠিক পরিচিতি
গাছটির নাম ‘আসন’ নাকি ‘আসান’, তা নিয়ে দীর্ঘদিনের বিতর্ক রয়েছে। অনেকের মতে, গাছটির আসল নাম ‘আসন’, যা ইংরেজদের উচ্চারণে ‘আসান’ হয়ে গেছে। এর প্রমাণ হিসেবে ‘আসনবনি’ বা ‘আসনবন’ এর মতো জায়গার নাম উল্লেখ করা হয়। তবে উদ্ভিদবিদরা জানান, ‘আসন’ এবং ‘আসান’ দুটি ভিন্ন প্রজাতির গাছ। ‘আসন’ একটি আয়ুর্বেদিক গাছ, যা থেকে রস নিঃসৃত হয় এবং এটি মধ্য ও দক্ষিণ ভারতে বেশি দেখা যায়। অন্যদিকে, ‘আসান’ একটি শক্ত শাল প্রজাতির বৃক্ষ, যা আসবাব তৈরিতে ব্যবহৃত হয় এবং এর থেকে রস নিঃসৃত হয় না। আসানসোলে একদা যে বৃক্ষ দেখা যেত, তা এই শাল প্রজাতির ‘আসান’ গাছই ছিল।
‘আসান’ বিলুপ্তির কারণ ও বিবি কলেজের উদ্যোগ
আসানসোল শহরের নামকরণের উৎস হওয়া সত্ত্বেও এই ‘আসান’ গাছ আজ প্রায় বিলুপ্ত। বর্তমানে আসানসোল বিবি কলেজে একটি এবং আসানসোল গার্লস কলেজে আরও একটি মাত্র ‘আসান’ গাছের সন্ধান মিলেছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, শিল্পনগরী গড়ে তোলার জন্য নির্বিচারে গাছ কাটা এবং জনবসতি স্থাপনের উদ্দেশ্যে বনভূমি ধ্বংসই এই গাছের বিলুপ্তির প্রধান কারণ। কিন্তু এর আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো, এই গাছের অঙ্কুরোদগমের হার খুবই কম। বিবি কলেজের বটানি বিভাগের অধ্যাপক জানিয়েছেন, “আসান গাছের অঙ্কুরোদগমের হার ৫০ শতাংশেরও কম। আমরা বাঁকুড়া থেকে যে হারে বীজ এনেছিলাম, তার প্রায় ৪০ শতাংশ বীজে আমরা অঙ্কুরোদগম ঘটাতে পেরেছি।”
এই প্রতিকূলতার মধ্যেও বিবি কলেজের অধ্যক্ষ অমিতাভ বসু এবং বটানি বিভাগের অধ্যাপক ড. অনিমেষ মণ্ডলের নেতৃত্বে শুরু হয় ‘আসান’ গাছ ফিরিয়ে আনার এই মহৎ উদ্যোগ। আসানসোল শহরে ‘আসান’ গাছের বীজ না পাওয়ায় বাঁকুড়া থেকে বীজ সংগ্রহ করা হয়। এই বীজ থেকে চারা তৈরি করতে বটানি বিভাগ এবং এনএসএস-এর ছাত্রছাত্রীদের প্রচুর পরিশ্রম করতে হয়েছে, কারণ বীজের অঙ্কুরোদগমের হার এতটাই কম।
এনএসএস বিভাগের সুকুমার দে জানিয়েছেন যে, ছাত্রছাত্রীরা এই কাজে প্রচণ্ড উৎসাহিত হয়েছেন। শহরের নাম যে গাছ থেকে এসেছে, সেই গাছকে নিজ হাতে গড়ে তোলার অভিজ্ঞতা তাদের কাছে এক ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছে। এই পাঁচ হাজার চারা বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা, যারা গাছ পরিচর্যা করে, তাদের এবং আগ্রহী ব্যক্তি ও সংগঠনের কাছে বিতরণ করা হবে।
বিবি কলেজের এই উদ্যোগ শুধু একটি বৃক্ষরোপণ অভিযান নয়, এটি আসানসোল শহরের হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনার এক প্রতীকী পদক্ষেপ। আশা করা যায়, এই উদ্যোগের ফলে অদূর ভবিষ্যতে আসানসোল শহর আবারও তার নিজস্ব ‘আসান’ বৃক্ষের পরিচয়ে সবুজ হয়ে উঠবে।
আসানসোলের এই উদ্যোগটি কেমন লাগলো? আপনার যদি এই বিষয়ে আরও কিছু জানার থাকে, তবে জিজ্ঞাসা করতে পারেন।
আরও পড়ুন: শিশুদের মনোযোগ বৃদ্ধিতে বিপ্লব—দেশজুড়ে জনপ্রিয় হচ্ছে ‘ব্রেইন ট্রেনিং’ পাঠদান পদ্ধতি