Switzerland: আধুনিক বিশ্ব রাজনীতিতে শক্তি, প্রভাব এবং সামরিক ক্ষমতার দাপটই যেন রাষ্ট্রের অবস্থানকে নির্ধারণ করে। তবুও একটি দেশ আছে, যে দেশটি শত শত বছর ধরে নিরপেক্ষ থেকেও বিশ্বমঞ্চে সম্মান, বিশ্বাস ও প্রভাব বজায় রাখতে পেরেছে। দেশটির নাম সুইজারল্যান্ড। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহ সময়েও যখন ইউরোপ জুড়ে আগুন জ্বলছিল, তখনও এই ছোট দেশটি নিরপেক্ষ নীতির কারণে আক্রমণ থেকে রক্ষা পেয়েছিল এবং একইসঙ্গে বৈশ্বিক বাণিজ্যে নিজেদের অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করে তুলেছিল।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিরপেক্ষতার সাফল্য
১৯৩৯ থেকে ১৯৪৫ সালের মধ্যে পৃথিবী ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ যুদ্ধের মুখোমুখি হয়েছিল। জার্মানি, ইতালি, সোভিয়েত ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র—প্রায় সব বড় শক্তিই এতে জড়িয়ে পড়ে। ইউরোপের প্রায় প্রতিটি দেশই কোন না কোনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। কিন্তু সুইজারল্যান্ড সেই ভয়াবহ ক্ষয়ক্ষতি থেকে নিজেদের বাঁচাতে সক্ষম হয়।
কেন? কারণ তাদের দীর্ঘদিনের নিরপেক্ষতা নীতি। ১৯শ শতক থেকেই সুইজারল্যান্ড আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ঘোষণা করে যে তারা কোনো যুদ্ধের পক্ষ নেবে না এবং নিজেদের নিরাপত্তা ও স্বার্থ রক্ষায় কেবল প্রতিরক্ষামূলক ভূমিকা পালন করবে। ফলস্বরূপ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্রশক্তি ও অক্ষশক্তি উভয়ই সুইজারল্যান্ডকে সরাসরি আক্রমণ করা থেকে বিরত থাকে।
অর্থনৈতিক সুবিধা
যখন চারপাশের দেশগুলো যুদ্ধ ও ধ্বংসযজ্ঞে লণ্ডভণ্ড হচ্ছিল, তখন সুইজারল্যান্ড তার বাণিজ্য ও ব্যাংকিং খাতকে ব্যবহার করে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হতে থাকে। জার্মান শিল্পপতি থেকে শুরু করে ব্রিটিশ ব্যবসায়ী, এমনকি রাজনৈতিক নেতারাও তাদের সম্পদ নিরাপদ রাখতে সুইস ব্যাংকগুলোতে জমা রাখত।
এই আস্থার ভিত্তি গড়ে ওঠে মূলত সুইস ব্যাংকিং ব্যবস্থার কঠোর গোপনীয়তা নীতির ওপর। বিশ্বের অন্যান্য স্থানে অর্থনীতি ধ্বসে পড়লেও সুইজারল্যান্ড স্থিতিশীল থেকে ধীরে ধীরে বৈশ্বিক আর্থিক শক্তিতে পরিণত হয়।
ভৌগোলিক নিরাপত্তা
সুইজারল্যান্ডকে রক্ষা করেছে কেবল কূটনৈতিক নিরপেক্ষতা নয়, বরং প্রাকৃতিক ভৌগোলিক অবস্থানও। আল্পস পর্বতমালা দেশটিকে ঘিরে রেখেছে এক প্রাকৃতিক দুর্গের মতো। কঠিন পাহাড়ি অঞ্চল দিয়ে বিদেশি সেনাদের প্রবেশ করা অত্যন্ত দুরূহ কাজ। ফলে শত্রু আক্রমণ প্রতিহত করা তাদের জন্য সহজ হয়ে যায়।
এছাড়া, সুইস সরকার বহু আগে থেকেই প্রতিরক্ষার জন্য অসংখ্য বাঙ্কার নির্মাণ করেছে। অনুমান করা হয়, দেশটির প্রতিটি নাগরিকের জন্য আলাদা আশ্রয়কেন্দ্র বা বাঙ্কারের ব্যবস্থা রয়েছে। এমনকি পরমাণু যুদ্ধের পরিস্থিতিতেও কয়েক মাস ধরে নিরাপদে থাকার মতো অবকাঠামো সেখানে তৈরি করা হয়েছে।
সুইস নিরপেক্ষতার বিশ্বাসযোগ্যতা
বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে আজ পর্যন্ত সুইজারল্যান্ড তার নিরপেক্ষতা বজায় রেখেছে। জাতিসংঘের মতো বৈশ্বিক সংস্থায় যোগদান করতেও তারা অনেক দেরি করেছে, কারণ নিরপেক্ষ অবস্থান নষ্ট হয়ে যেতে পারে বলে তারা আশঙ্কা করেছিল। যদিও ২০০২ সালে দেশটি জাতিসংঘে যোগ দেয়, তবুও সামরিক জোটে যুক্ত হওয়ার ব্যাপারে এখনো তারা দূরত্ব বজায় রেখেছে।
সুইস নিরপেক্ষতা এতটাই বিশ্বস্ত হয়ে উঠেছে যে আন্তর্জাতিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত মেটানোর ক্ষেত্রেও সুইজারল্যান্ডকে একটি নিরাপদ স্থান হিসেবে ব্যবহার করা হয়। অসংখ্য আন্তর্জাতিক বৈঠক, শান্তিচুক্তি কিংবা ব্যবসায়িক চুক্তি সুইস শহর জেনেভায় অনুষ্ঠিত হয়।
আজকের সুইজারল্যান্ড
বর্তমান সময়ে সুইজারল্যান্ড কেবল নিরপেক্ষতার কারণে নয়, বরং শিক্ষা, স্বাস্থ্য, প্রযুক্তি ও অর্থনীতির ক্ষেত্রেও শীর্ষে রয়েছে। দেশটি বিশ্বের অন্যতম ধনী রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে একটি। জীবনমান, আয়ু, নাগরিক সুরক্ষা এবং মানবিক সূচকে সুইজারল্যান্ড নিয়মিতভাবেই শীর্ষ স্থানে থাকে।
কেন একে “নিরপেক্ষ কিন্তু শক্তিশালী” বলা হয়?
- নিরপেক্ষতা নীতি: কোনো সামরিক জোট বা যুদ্ধের পক্ষ না নেওয়া।
- অর্থনৈতিক শক্তি: ব্যাংকিং ও বাণিজ্যে বৈশ্বিক আস্থা অর্জন।
- ভৌগোলিক নিরাপত্তা: আল্পস পর্বতমালা ও উন্নত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা।
- আন্তর্জাতিক বিশ্বাসযোগ্যতা: শান্তি প্রতিষ্ঠায় অবদান এবং কূটনৈতিক নির্ভরযোগ্যতা।
সব মিলিয়ে সুইজারল্যান্ড এমন এক অনন্য উদাহরণ, যেখানে সামরিক আগ্রাসন ছাড়াই কেবল নিরপেক্ষতা, কূটনৈতিক দক্ষতা এবং অর্থনৈতিক প্রজ্ঞার মাধ্যমে একটি ছোট দেশ বিশ্বে অন্যতম প্রভাবশালী শক্তিতে পরিণত হয়েছে।
সুইজারল্যান্ড প্রমাণ করেছে, শক্তি মানেই যুদ্ধ নয়, কিংবা ক্ষমতা মানেই আগ্রাসন নয়। বরং নিরপেক্ষ থেকেও একটি দেশ বিশ্বে সম্মানিত ও প্রভাবশালী হতে পারে। আজকের পৃথিবীতে যেখানে প্রতিদিন নতুন সংঘাত তৈরি হচ্ছে, সেখানে সুইজারল্যান্ডের এই নিরপেক্ষ কিন্তু শক্তিশালী অবস্থান অন্যদের জন্যও এক অনন্য শিক্ষা হয়ে থাকবে।
আরও পড়ুন: শিশুদের মানসিক বিকাশে কার্টুন: আনন্দের সঙ্গেই সতর্কতার বার্তা