Plastic-Eating Fungus: পূর্বঘাটের সবুজ-শ্যামল অরণ্যের বুক চিরে উঠে এল এমন এক বৈজ্ঞানিক সাফল্যের খবর, যা শুধু ভারত নয়, পুরো বিশ্বের পরিবেশ-সংকট মোকাবিলায় এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে। ভারতের ভূতাত্ত্বিক বিজ্ঞানীরা সম্প্রতি আবিষ্কার করেছেন এক বিশেষ প্রজাতির ছত্রাক (ফাঙ্গাস), যার অসাধারণ ক্ষমতা রয়েছে প্লাস্টিক গলিয়ে খাওয়ার। প্লাস্টিক দূষণ আজ বিশ্বব্যাপী এক মহামারি; সেই প্রেক্ষাপটে এই আবিষ্কারকে ‘গেম চেঞ্জার’ বলেই অভিহিত করছেন বিশেষজ্ঞরা।
আবিষ্কারের প্রেক্ষাপট
প্লাস্টিকের অবক্ষয় সাধারণত শত থেকে হাজার বছর সময় নেয়। নদী, সাগর, বন— কোথাওই প্লাস্টিকের বিষাক্ত প্রভাব থেকে মুক্ত নয়। ভারতে প্রতিবছর কয়েক মিলিয়ন টন প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরি হয়, যার একটি বড় অংশ খোলা পরিবেশে বা জলাশয়ে জমে থাকে। এই পরিস্থিতিতেই ভারতের একদল ভূতাত্ত্বিক এবং জীববিজ্ঞানী এক যৌথ অভিযানে পূর্বঘাটের অরণ্যে গিয়েছিলেন মাটি ও উদ্ভিদ নমুনা সংগ্রহ করতে। সেখানেই ঘটে যায় চমকপ্রদ ঘটনা।
কিভাবে মিলল ছত্রাকটির খোঁজ
গবেষক দলের নেতৃত্বে ছিলেন ড. অনিরুদ্ধ বন্দ্যোপাধ্যায়, যিনি দীর্ঘদিন ধরে মাইক্রোবায়োলজিক্যাল অবক্ষয় নিয়ে কাজ করছেন। তিনি জানান, পূর্বঘাটের এক প্রত্যন্ত অরণ্যে মাটির নমুনা সংগ্রহ করার সময় দলটি লক্ষ্য করে যে, একটি শুকনো পাতার ওপর আটকে থাকা প্লাস্টিকের পাতলা ফিল্ম অস্বাভাবিকভাবে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়েছে। মাইক্রোস্কোপে পরীক্ষা করতেই দেখা যায়— সেই প্লাস্টিকের ওপর সাদা তুলোর মতো ছত্রাকের বিস্তার।
পরীক্ষাগারে নিয়ে গিয়ে আলাদা করে চাষ করার পর দেখা যায়, এই ছত্রাক পলিথিন এবং পলিপ্রপিলিন— দুই ধরনের প্লাস্টিকই ধীরে ধীরে ভেঙে ফেলতে পারে।
বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ
পরীক্ষায় প্রমাণিত হয়েছে যে, এই ছত্রাকের মধ্যে উপস্থিত কিছু বিশেষ এনজাইম (যেমন পলিইথিলিনেজ ও পলিপ্রোপিলিনেজ) প্লাস্টিকের দীর্ঘ শৃঙ্খলযুক্ত পলিমারকে ছোট ছোট টুকরোতে ভেঙে দেয়। এই প্রক্রিয়াকে বলা হয় বায়োডিগ্রেডেশন। প্রচলিত রাসায়নিক বা শারীরিক অবক্ষয়ের তুলনায় এই পদ্ধতিটি অনেক বেশি পরিবেশবান্ধব এবং কম খরচসাপেক্ষ।
গবেষকরা আরও জানান, ল্যাবরেটরির নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে এই ছত্রাক প্রায় ৪৫ দিনের মধ্যে পাতলা পলিথিন ব্যাগের ৫০% পর্যন্ত ভেঙে ফেলতে সক্ষম হয়েছে। এটি বৈশ্বিক গবেষণার মানদণ্ডে একটি অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক ফলাফল।
আবিষ্কারের গুরুত্ব
- পরিবেশ রক্ষায় নতুন দিগন্ত – প্লাস্টিক দূষণ প্রতিরোধে জৈবপদ্ধতি অনেক বেশি নিরাপদ।
- শিল্পক্ষেত্রে প্রয়োগের সম্ভাবনা – বর্জ্য ব্যবস্থাপনা শিল্পে এই ছত্রাককে ব্যবহার করে বড় মাত্রায় প্লাস্টিক অবক্ষয় সম্ভব।
- কম খরচে সমাধান – রাসায়নিক রিসাইক্লিং প্রক্রিয়ার তুলনায় এটি অনেক সস্তা।
- বনাঞ্চলের জীববৈচিত্র্য রক্ষার গুরুত্ব – এই আবিষ্কার প্রমাণ করে যে, অজানা জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ভবিষ্যতের পরিবেশ সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
চ্যালেঞ্জ এবং সীমাবদ্ধতা
যদিও আবিষ্কারটি বৈপ্লবিক, তবে গবেষকরা সতর্ক করছেন যে, বাস্তবে বৃহৎ পরিসরে এই প্রযুক্তি প্রয়োগের আগে আরও গভীর পরীক্ষা-নিরীক্ষা প্রয়োজন।
- ছত্রাকটির বৃদ্ধির গতি
- বহিঃপরিবেশে এর কার্যকারিতা
- শিল্প পর্যায়ে উৎপাদন ও সংরক্ষণ পদ্ধতি
এসব বিষয়ে সুনির্দিষ্ট গবেষণা এখনও চলছে। এছাড়া, এই ছত্রাক যেন পরিবেশের অন্যান্য প্লাস্টিক-নির্ভর কাঠামো (যেমন বিদ্যুতের তারের ইনসুলেশন বা নিরাপত্তা সরঞ্জাম) ক্ষতি না করে, তা নিশ্চিত করাও জরুরি।
গ্লোবাল প্রতিক্রিয়া
আন্তর্জাতিক বৈজ্ঞানিক মহল ভারতের এই আবিষ্কারকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানিয়েছে। আমেরিকা ও ইউরোপের একাধিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইতিমধ্যেই যৌথ গবেষণায় আগ্রহ প্রকাশ করেছে। জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচি (UNEP) এই আবিষ্কারের প্রাথমিক রিপোর্ট সংগ্রহ করেছে এবং প্লাস্টিক দূষণ হ্রাসে সম্ভাব্য প্রয়োগের খসড়া পরিকল্পনা তৈরি করছে।
পূর্বঘাট: অজানা সম্ভাবনার ভান্ডার
পূর্বঘাটের অরণ্য বরাবরই তার সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্যের জন্য পরিচিত। এখানে বহু বিরল প্রজাতির উদ্ভিদ, পোকা-মাকড় ও ছত্রাক পাওয়া যায়, যাদের নিয়ে এখনও বিস্তৃত গবেষণা হয়নি। বিজ্ঞানীরা বলছেন, বনাঞ্চল ধ্বংসের আগে এই ধরনের গবেষণা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চালানো উচিত, কারণ একবার প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে গেলে তাকে আর ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়।
সাধারণ মানুষের ভূমিকা
যদিও বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার সমস্যার সমাধানের পথ খুলে দেয়, তবুও প্লাস্টিক দূষণ রোধে সাধারণ মানুষের সচেতনতা অপরিহার্য। পুনর্ব্যবহারযোগ্য ব্যাগ ব্যবহার, একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক বর্জন, সঠিক বর্জ্য নিষ্পত্তি— এসব অভ্যাস আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অংশ হওয়া উচিত। এই ছত্রাক হয়তো ভবিষ্যতে সমাধান আনবে, কিন্তু ততদিনে আমাদেরই দায়িত্ব নিতে হবে।
ভবিষ্যতের দিশা
ড. অনিরুদ্ধ বন্দ্যোপাধ্যায় ও তার দল জানিয়েছেন, তারা এখন এই ছত্রাকের জিনোম বিশ্লেষণ করছেন, যাতে এনজাইম উৎপাদন ক্ষমতা আরও বৃদ্ধি করা যায়। ভবিষ্যতে ‘বায়ো-রিঅ্যাক্টর’-এ এই ছত্রাক চাষ করে শিল্প পর্যায়ে প্লাস্টিক গলানোর প্রক্রিয়া চালু করার পরিকল্পনা রয়েছে। যদি এই প্রক্রিয়া সফল হয়, তবে আগামী কয়েক দশকের মধ্যে প্লাস্টিক দূষণের সমস্যা অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হবে।
পূর্বঘাটের গভীর অরণ্য থেকে উঠে আসা এই ছোট্ট ছত্রাক হয়তো একদিন বিশ্বের সবচেয়ে বড় পরিবেশ দূষণ সমস্যার সমাধান দেবে। এটি কেবল একটি বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার নয়— এটি একটি আশার আলো, যা মনে করিয়ে দেয়, প্রকৃতি নিজেই তার সমস্যার সমাধান লুকিয়ে রাখে; কেবল আমাদের চোখ খুলে তা খুঁজে নিতে হয়।
আরও পড়ুন: শতবর্ষে ‘আবোল তাবোল’, নতুন রূপে হাওড়ার বিদ্যালয়
[…] […]