Varahamihira: আজকের যুগে ভূমিকম্প বিজ্ঞান বা “সিসমোলজি” এক আধুনিক গবেষণার বিষয়। টেকটোনিক প্লেট, ভূস্তরের গতিবিধি, রিখটার স্কেল—এসব পরিভাষা দিয়ে ভূমিকম্প বিশ্লেষণ করা হয়। কিন্তু অবাক করা বিষয় হলো, এই আধুনিক গবেষণার বহু শতক আগে, খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতকে এক প্রাচীন ভারতীয় পণ্ডিত এই প্রাকৃতিক বিপর্যয় নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা করেছিলেন। তাঁর নাম—বরাহমিহির। তিনি তাঁর কালজয়ী গ্রন্থ “বৃহৎ সংহিতা”-র ৩২তম অধ্যায়ে “ভূকম্প লক্ষণ” বা ভূমিকম্পের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার একটি চমকপ্রদ উপস্থাপনা দিয়েছেন।
বরাহমিহির: যিনি বিজ্ঞানের সীমা পেরিয়ে দর্শন ও জ্যোতির্বিজ্ঞান মিলিয়ে দেখেছিলেন বিশ্বকে
বরাহমিহির ছিলেন প্রাচীন ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ জ্যোতির্বিদ, গণিতজ্ঞ ও প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের গবেষক। তিনি গৌতম বংশের অন্তর্গত ছিলেন এবং উদয়গিরি (বর্তমান মধ্যপ্রদেশ) অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর রচিত “পঞ্চসিদ্ধান্তিকা”, “বৃহৎ সংহিতা” এবং “বৃহজ্জাতিক” তাঁকে শুধু ভারতের নয়, বিশ্বের শ্রেষ্ঠ প্রাচীন বিজ্ঞানীদের তালিকায় স্থান দিয়েছে।
“বৃহৎ সংহিতা” ও ভূমিকম্পতত্ত্ব:
বরাহমিহিরের “বৃহৎ সংহিতা” হল একটি বিশ্বকোষ-সদৃশ গ্রন্থ, যেখানে জ্যোতির্বিদ্যা, আবহাওয়া, বাস্তুতত্ত্ব, কৃষি, প্রাণীচর্চা, স্বপ্ন বিশ্লেষণ এমনকি রত্নবিদ্যা পর্যন্ত স্থান পেয়েছে। এই গ্রন্থের ৩২তম অধ্যায় “ভূকম্প-লক্ষণ”-এ তিনি ভূমিকম্পের কারণ, পূর্বাভাস, প্রাক-লক্ষণ এবং ফলাফল নিয়ে বিশদ আলোচনা করেছেন।
ভূমিকম্পের কারণ: প্রাক-আধুনিক যুক্তিবোধের এক অভাবনীয় উদাহরণ
বরাহমিহির লিখেছেন, ভূমিকম্পের পেছনে একাধিক সম্ভাব্য কারণ রয়েছে:
- আকাশ ও পৃথিবীর মধ্যে শক্তির বিনিময়
- জলাধার বা গহ্বরের পরিবর্তন
- ভূগর্ভস্থ বায়ু ও আগ্নেয় পদার্থের সঞ্চালন
- দেবতাদের ক্রোধ বা ঐশ্বরিক ইচ্ছা (যদিও এটি প্রতীকী ব্যাখ্যা হিসেবেই বেশি ব্যবহৃত হয়েছে)
- জলচক্রের পরিবর্তন, ভূগর্ভস্থ জলাধারের চাপ
এই তত্ত্বগুলো আধুনিক টেকটোনিক প্লেট থিওরির সঙ্গে হুবহু মিলে না গেলেও আশ্চর্যরকমভাবে অনেক জায়গায় বাস্তববিজ্ঞানভিত্তিক বিশ্লেষণের ইঙ্গিত বহন করে।
ভূমিকম্প মেঘ: বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণের এক ব্যতিক্রমী অধ্যায়
বরাহমিহির তাঁর আলোচনায় ভূমিকম্পের সঙ্গে এক বিশেষ ধরনের মেঘের সম্পর্ক ব্যাখ্যা করেছেন—যা তিনি “ভূমিকম্প মেঘ” নামে উল্লেখ করেছেন। তাঁর মতে, ভূমিকম্পের আগে আকাশে অদ্ভুত ধরনের মেঘের গঠন হয়, তাদের রং, আকার ও গতিবিধি সাধারণ মেঘের তুলনায় আলাদা হয়। আজকের দিনে বৈজ্ঞানিক মহলেও এই ধরনের প্রাকৃতিক লক্ষণ পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে ভূমিকম্পের পূর্বাভাস নিয়ে গবেষণা চলছে।
আধুনিক “Earthquake Light” বা ভূকম্পীয় আলো নিয়েও গবেষণায় উঠে এসেছে যে, ভূমিকম্পের আগে কখনো কখনো আকাশে অস্বাভাবিক আলোর প্রতিফলন দেখা যায়। বরাহমিহির সেই যুগেই এসব প্রাকৃতিক ইঙ্গিত চিনে ফেলেছিলেন—তা নিঃসন্দেহে বিস্ময়কর।
প্রাক-ভূমিকম্প লক্ষণ: পশুপাখির অস্বাভাবিক আচরণও আলোচনায়
বরাহমিহির লিখেছেন, ভূমিকম্পের আগেই পশুপাখি ও পোকামাকড়ের আচরণে বিশেষ পরিবর্তন দেখা যায়। হাঁস-মুরগি, কুকুর, বিড়াল, এমনকি গবাদি পশু অস্থির হয়ে ওঠে, জায়গা বদল করতে থাকে বা অদ্ভুত শব্দ করে। এই বিষয়ে আজও বিজ্ঞানীরা একমত যে প্রাণীরা ভূগর্ভস্থ কম্পনের তরঙ্গ অনেক আগে অনুভব করতে পারে এবং তার প্রতিক্রিয়া দেখায়।
আধুনিক বিজ্ঞান ও বরাহমিহিরের মিল:
যদিও বরাহমিহিরের তত্ত্বগুলো আধুনিক সিসমোলজির মতো নির্ভুল নয়, তবুও তাঁর পর্যবেক্ষণ, যুক্তি এবং বিশ্লেষণের ধরণ প্রমাণ করে যে প্রাচীন ভারতে বিজ্ঞান এক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছেছিল। ভূমিকম্প মেঘ, পশুপাখির পূর্বাভাস, ভূগর্ভস্থ পরিবর্তনের ব্যাখ্যা—এসব কেবল কল্পনা নয়, বাস্তব পর্যবেক্ষণের ফল।
ভারতীয় ঐতিহ্যের গর্ব: প্রাচীন জ্ঞান-বিজ্ঞানের অমূল্য রত্ন
বরাহমিহির ছিলেন এমন এক যুগের প্রতিভা, যখন বিজ্ঞানের ভাষা ছিল যুক্তি ও বিশ্লেষণ, যদিও সেই সময়কার প্রযুক্তি সীমাবদ্ধ ছিল। আজকের দিনে যখন ভূমিকম্পের সময় মানুষ আতঙ্কে কেঁপে ওঠে, তখন ভাবা দরকার—যে জাতি বরাহমিহিরের মতো বিজ্ঞানী জন্ম দিয়েছিল, তার হাতে ছিল ভবিষ্যতের দিশা।
উপসংহার:
আজ যখন আধুনিক প্রযুক্তি ও গবেষণা ভূমিকম্পের প্রাক-সতর্কতা ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটাতে ব্যস্ত, তখন পিছন ফিরে দেখা দরকার আমাদের নিজের ইতিহাসের দিকে। বরাহমিহির প্রমাণ করে গিয়েছেন—প্রাচীন ভারতের জ্ঞান শুধুই অতীত স্মৃতি নয়, বরং বর্তমানের গবেষণারও পথপ্রদর্শক।
১৫০০ বছর আগে এক ভারতীয় বিজ্ঞানী তাঁর যুক্তিভিত্তিক চিন্তাধারায় যে আলো জ্বালিয়েছিলেন, তা আজও বিজ্ঞানের আঙিনায় অনুপ্রেরণা হয়ে রয়ে গেছে। বরাহমিহির, তাঁর বৃহৎ সংহিতা, এবং ভূমিকম্প-তত্ত্ব আমাদের শিখিয়ে দেয়—ভবিষ্যতের বিজ্ঞান লুকিয়ে থাকতে পারে অতীতের পাতায়।