Child First Screen Later: ভাইরালের নেশা, শৈশবের সর্বনাশ
ঘরে বাচ্চা আধো আধো গলায় বলল, “আমাকে কি চেকচি নাগচে?”— সঙ্গে সঙ্গে হেসে উঠলেন বাবা-মা, দাদু-ঠাকুমা, পরিবারের সবাই। ভিডিও করে আপলোড করা হলো ইনস্টাগ্রামে। লাইক, কমেন্টের বন্যা। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে— এই হাসির আড়ালে কী হারাচ্ছে সেই শিশুটি?
এমনই চিত্র প্রতিনিয়ত দেখা যাচ্ছে হাজারো বাঙালি পরিবারের ঘরে ঘরে। বয়স দুই কিংবা তিন, ভাষার অর্থ না বুঝেই বাচ্চারা অনুকরণ করছে রিলস-এর সংলাপ, গাইছে সিনেমার কুরুচিপূর্ণ গান। এবং আমরা— বাবা-মা, অভিভাবক, সমাজ— নিজেদের কাজ সারতে বা শান্তি বজায় রাখতে এই ‘ডিজিটাল খেলা’তে সন্তানকে ঠেলে দিচ্ছি।
শান্ত বাচ্চা মানেই সুখী বাচ্চা নয়
বাচ্চারা যখন একটানা কার্টুন দেখে বা রিলস স্ক্রল করে যায়, তখন আমরা ভাবি— শান্ত রয়েছে, ঝামেলা করছে না। অথচ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই শান্তি এক ভয়াবহ সংকেত। শিশুর মস্তিষ্ক গঠনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় আট বছর বয়স পর্যন্ত। তার আগেই যদি তারা মোবাইল স্ক্রিনে বন্দি হয়ে পড়ে, তাহলে তাদের সৃজনশীলতা, কল্পনা শক্তি, বাস্তবের সঙ্গে সংযোগ এবং মনঃসংযোগ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
অলীক জগতে হারিয়ে যাচ্ছে বাস্তব শৈশব
বর্তমান প্রজন্মের শিশুদের দিন কাটে মোবাইলের রঙিন স্ক্রিনে, ইউটিউব কার্টুনের চরিত্রে, ইনস্টাগ্রামের রিল কন্টেন্টে। তারা গাছের ছায়ায় খেলাধুলা করে না, পাখির ডাক শোনে না, বইয়ের পাতায় ডুবে যায় না। তারা জানে না ফুলের ঘ্রাণ, চেনা বন্ধুদের সঙ্গে খুনসুটি, কিংবা গল্পের জগতে হারিয়ে যাওয়ার আনন্দ।
যৌথ পরিবার নয়, এখন একা শিশুরা
যৌথ পরিবারের বিলুপ্তি এবং কর্মব্যস্ত বাবা-মার কারণে শিশুরা আজ একা। আগে ঠাকুমা-দাদু, পিসি-মাসিরা থাকতেন তাদের চারপাশে, থাকত গল্প বলা, খেলার সাথী। এখন এসব নেই। সময় না থাকার অজুহাতে আমরা সন্তানের হাতে তুলে দিচ্ছি মোবাইল। আর সেখানেই ঢুকে পড়ছে বাণিজ্যিক, বয়স-অনুপযোগী, বিকৃত কনটেন্ট।
বাচ্চারা যা শোনে, তা-ই শেখে
অসংখ্য গবেষণায় দেখা গেছে, শিশুরা যা দেখে বা শোনে, তাই অনুকরণ করে। অনেকেই না বুঝেই যৌনতাসূচক সংলাপ বা কুরুচিপূর্ণ গানের কলি মুখস্থ করছে। একবার ভাবুন— এ সব শব্দ তাদের মনোজগতে কী ছাপ ফেলে? তাদের মানসিক গঠন কি তখন সুস্থ থাকবে?
সামাজিক দক্ষতা কমে যাচ্ছে
মোবাইল-নির্ভরতা শিশুকে করে তুলছে অন্তর্মুখী। তারা আর সামাজিকভাবে আত্মপ্রকাশ করতে পারে না। মুখোমুখি কথা বলার দক্ষতা হারাচ্ছে, সহজ বন্ধুত্ব করতে পারছে না। তারা যেন এক রোবট হয়ে উঠছে— যার বন্ধু ফিল্টার, whose world ends in ‘next video’.
ভাইরালের আশায় অবচেতনকে বলি
সমস্যা আরও গভীর। শিশুর নিষ্পাপ কথাবার্তা, ভুল উচ্চারণ, নাচ, গানকে আমরা সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল করে তুলছি। ‘লাইক’, ‘কমেন্ট’, ‘ফলোয়ার’-এর লোভে আমরা ভুলে যাচ্ছি, সন্তান খেলনার পুতুল নয়। তার ব্যক্তিত্ব, সম্মান, গোপনীয়তা রয়েছে। সে বুঝতেই পারছে না তার জীবন একটি পাবলিক শো হয়ে উঠেছে।
দায় আমাদেরই— বাবা-মা ও সমাজ
এই অবস্থার জন্য কেবল প্রযুক্তি নয়, দায় আমাদের— বাবা-মা, পরিবার, সমাজের। সময়ের অভাব, ডিজিটাল বিকল্পে ভরসা, জনপ্রিয়তার নেশা— সব মিলিয়ে আমরা সন্তানকে স্বাভাবিক জীবনের বাইরে নিয়ে যাচ্ছি। নিজেদের ব্যস্ততার খেসারত দিচ্ছে তারা।
সমাধান— সময় দিন, ভালোবাসুন, সাহচর্য দিন
সমাধান একটাই— শিশুরা চায় সাহচর্য। তারা চায় খেলার সাথী, চায় কারও সঙ্গে ছবি আঁকা, গাছ লাগানো, বই পড়া। তারা চায় ঘুমের আগে একটা গল্প। আপনার দেওয়া সময়ই হবে তাদের জীবনের সবচেয়ে বড় উপহার।
করণীয় সংক্ষেপে:
সময় দিন— ফোন নয়
বয়স উপযোগী কনটেন্ট ফিল্টার করুন
প্রকৃতি, খেলা ও সৃজনশীল কাজে উৎসাহ দিন
গল্প বলুন, গল্প শুনুন— রিয়েল কনেকশন গড়ুন
সন্তানকে বিনা অনুমতিতে রেকর্ড বা আপলোড করা থেকে বিরত থাকুন
স্ক্রিন টাইম সীমিত করুন, লাইফ টাইম বাড়ান
এটা কেবল একটি পরিবারিক সমস্যা নয়, এটা এক সামাজিক সংকট
আজ যদি আমরা সচেতন না হই, তাহলে আগামী প্রজন্ম প্রযুক্তি-নির্ভর হলেও মানবিক বোধহীন, কল্পনাশক্তিহীন, সম্পর্কহীন এক যান্ত্রিক সমাজে পরিণত হবে। তারা জানবে না বইয়ের গন্ধ, আকাশের বিস্তার, কিংবা বন্ধুদের সঙ্গে বৃষ্টিতে ভিজে যাওয়ার আনন্দ।
এখনই সময় জেগে ওঠার
আসুন, আমরা সকলে মিলে এই ভয়াবহ স্রোতের বিপরীতে দাঁড়াই। আগে সন্তান, পরে স্ক্রিন— এই মন্ত্রেই ফিরিয়ে আনা সম্ভব আমাদের শিশুর হারাতে বসা শৈশব।
প্রযুক্তিকে নয়, মানবিকতাকে বানাই আগামী দিনের হাতিয়ার।
আপনার সময়ই আপনার সন্তানের জীবনের ভিত্তি।
আরও পড়ুন: সিকিমের বাঁশের জলবোতল: প্রাকৃতিক উপাদানে নতুন সম্ভাবনা