A New Era of Attention: বর্তমান সময়ের অন্যতম বড় শিক্ষাগত চ্যালেঞ্জ হচ্ছে শিশুদের মনোযোগ ধরে রাখা। স্মার্টফোন, ট্যাবলেট, ইউটিউব, গেমিং অ্যাপ—এইসব ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম শিশুদের মনকে এতটাই প্রভাবিত করছে যে, বইয়ে মনোযোগ দেওয়া আজকাল যেন অসম্ভব এক কাজ। কিন্তু এই বাস্তবতার মাঝেও আশাব্যঞ্জক এক পরিবর্তনের ইঙ্গিত মিলেছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের স্কুলে। এক নতুন পাঠদান পদ্ধতি—‘ব্রেইন ট্রেনিং’ বা ‘মাইন্ডফুল লার্নিং’—শিশুদের মনোযোগ বৃদ্ধির কার্যকর উপায় হিসেবে আলোচনায় উঠে এসেছে।
নতুন উদ্যোগের সূচনা
সম্প্রতি দেশের একাধিক প্রাথমিক ও উচ্চ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শুরু হয়েছে বিশেষ এক কর্মসূচি, যার মূল লক্ষ্য—শিক্ষার্থীদের মনোসংযোগ বৃদ্ধি করে শেখার মানোন্নয়ন। এই পদ্ধতির নাম দেওয়া হয়েছে ‘ব্রেইন-ফোকাস মেথড’। আন্তর্জাতিক মানের গবেষণার ভিত্তিতে নির্মিত এই পাঠদান কৌশল মূলত শিশুদের ব্রেন-ম্যাপিং, একাগ্রতা, শ্রবণ-স্মৃতি, ভিজ্যুয়াল লার্নিং এবং আত্মনিয়ন্ত্রণের দিকগুলোকে একত্রিত করে তৈরি করা হয়েছে।
শিক্ষকরা পাচ্ছেন বিশেষ প্রশিক্ষণ, যাতে তারা শিশুদের দৃষ্টি, মনোযোগ ও সংবেদনশীলতা বুঝে উপযুক্ত উপায়ে পড়াতে পারেন।
পদ্ধতিটি কীভাবে কাজ করে?
এই মাইন্ডফুল লার্নিং পদ্ধতি মূলত চারটি স্তম্ভের উপর ভিত্তি করে নির্মিত:
- মনোযোগ বৃদ্ধির কৌশল – শিশুদের শেখানো হয় কীভাবে নির্দিষ্ট সময়ে এক জায়গায় মনোযোগ ধরে রাখা যায়। ‘মনোযোগ ব্যায়াম’ নামে বিশেষ কিছু অনুশীলনের মাধ্যমে প্রতিদিন ক্লাস শুরু হয়।
- শ্রবণ ও স্মৃতিশক্তি উন্নয়ন – বিভিন্ন শব্দ বা বাক্য শুনে তা মনে রাখার খেলা বা কুইজের মাধ্যমে শেখানো হয় তথ্য সংগ্রহের কৌশল।
- ভিজ্যুয়াল ও কগনিটিভ লার্নিং – পাঠ্যবিষয়কে ছবির মাধ্যমে বোঝানো হয়। শিশুদের মস্তিষ্ক ‘দেখে’ যা শেখে, তা দীর্ঘস্থায়ী হয়।
- আত্মনিয়ন্ত্রণ ও ধৈর্য অনুশীলন – ধীরে পড়া, সময় নিয়ে প্রশ্ন সমাধান, সহপাঠীর মতামত শোনা ইত্যাদির মাধ্যমে আত্মসংযম শেখানো হয়।
লক্ষ্য শুধু ফল নয়, পূর্ণ বিকাশ
এই পদ্ধতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো, এটি শুধু পরীক্ষার ফলাফল বা নম্বর অর্জনের দিকেই নজর দেয় না। এর মূল উদ্দেশ্য শিশুর সমগ্র মানসিক বিকাশ—যাতে সে শুধু ‘বই পড়ে’ নয়, বরং নিজের অনুভব, বিশ্লেষণ ও সৃজনশীলতার মাধ্যমে শেখে।
এই শিক্ষায় ‘রুট মেমোরি’ বা কণ্ঠস্থ করার পরিবর্তে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে ‘অভিজ্ঞতামূলক শেখা’র উপর।
স্কুলে বাস্তব প্রয়োগ
কলকাতার উপকণ্ঠের একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চলতি বছরের শুরুতে পরীক্ষামূলকভাবে চালু হয় এই পদ্ধতি। প্রধান শিক্ষিকা শমিতা সেন বলেন,
“প্রথমে আমরা ভাবছিলাম বাচ্চারা মনোযোগ দিতে পারবে কি না। কিন্তু এক মাসের মধ্যেই দেখি, ওরা ক্লাসে আগের চেয়ে অনেক বেশি সক্রিয়। প্রশ্ন করে, গল্প বানায়, নিজেরাই পড়ে শেখে।”
অভিভাবকদের প্রতিক্রিয়া
অনেক অভিভাবক জানিয়েছেন, তাঁরা প্রথমে বিষয়টি নিয়ে সংশয়ী ছিলেন। কিন্তু এখন নিজেরাই সন্তানের পরিবর্তনে অবাক।
এক অভিভাবক, সায়ন্তন চক্রবর্তী জানান,
“আমার ছেলে আগে ৫ মিনিট বই নিয়ে বসত না। এখন সে নিজেই বই নিয়ে বসে, প্রশ্ন করে, এমনকি আমাকে শেখায়। এটা সত্যিই বিস্ময়কর।”
শিক্ষাবিদের মূল্যায়ন
শিক্ষাবিদ ও মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, ‘মনোযোগ’ আসলে শিখিয়ে দেওয়ার মতো একটি দক্ষতা—যা সচেতনভাবে চর্চার মাধ্যমে গড়ে তোলা যায়।
বিশিষ্ট শিশু মনোবিজ্ঞানী ডঃ মীনাক্ষী দত্ত বলেন,
“এই উদ্যোগ শুধু শিক্ষার জন্য নয়, শিশুর ভবিষ্যত জীবনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মনোযোগ ও ধৈর্য যদি ছোটবেলা থেকেই শেখানো যায়, তাহলে তারা ভবিষ্যতে যে কোনো ক্ষেত্রেই সাফল্য অর্জন করবে।”
বৈজ্ঞানিক ভিত্তি
এই পদ্ধতির পেছনে রয়েছে নিউরো-সায়েন্সের আধুনিক গবেষণা। শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশে ‘attention span’ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। গবেষণায় দেখা গেছে, নিয়মিত ‘ফোকাস অনুশীলন’ করালে নিউরোনের সংযোগ উন্নত হয়, যা দীর্ঘস্থায়ী স্মৃতি ও শেখার দক্ষতা বাড়ায়।
ফলাফল ও ভবিষ্যত পরিকল্পনা
যেসব স্কুলে ইতিমধ্যে এই পদ্ধতি চালু হয়েছে, তাদের মধ্যে ৮০% স্কুলেই শিক্ষার্থীদের একাডেমিক পারফরম্যান্স ও ক্লাসে অংশগ্রহণের হার বেড়েছে।
সরকারি ও বেসরকারি উভয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এই কার্যক্রম ধাপে ধাপে চালু করার পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে। আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকে রাজ্যের আরও ১০০টি স্কুলে এই পদ্ধতি চালুর কথা ভাবা হচ্ছে।
ছোট উদ্যোগ, বড় স্বপ্ন
একটা ছোট পদক্ষেপ—কিন্তু তার প্রভাব হতে পারে বহু দূর পর্যন্ত। ‘ব্রেইন ট্রেনিং’ বা ‘মাইন্ডফুল লার্নিং’ এমন এক যুগান্তকারী পদ্ধতি, যা হয়তো আগামী দিনের শিক্ষা বিপ্লবের দিশারি হয়ে উঠতে পারে।
একজন শিক্ষক যেমন বলেছিলেন,
“এই পদ্ধতি শুধু বাচ্চাদের শেখাচ্ছে না, আমাদের শিক্ষকদেরও শেখাচ্ছে—শিক্ষার আসল মানে কী।”
উপসংহার
শিশুরা ভবিষ্যতের পথপ্রদর্শক। তাদের মনোযোগী, আত্মনিয়ন্ত্রিত ও অনুভবসম্পন্ন করে গড়ে তোলার দায়িত্ব আমাদের সবার। প্রযুক্তির যুগে যদি আমরা তাদের শেখার প্রতি ভালোবাসা জাগাতে পারি, তবেই আগামী প্রজন্ম হবে সত্যিকার অর্থে জ্ঞাননিষ্ঠ, সৃজনশীল ও সুসংগঠিত। আর সেই দিশায় ‘ব্রেইন ট্রেনিং’ একটি নতুন আশার আলো।
আরও পড়ুন: নতুন রেল রুটে এক হচ্ছে হাওড়া, হুগলি, বাঁকুড়া: তারকেশ্বর-বিষ্ণুপুর প্রকল্পে এল বিরাট সুখবর!
[…] […]